গাইড কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ

শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। প্রতিবছরের মতো এবারও বছরের শুরুতেই বিনা মূল্যে নতুন বই হাতে পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। তবে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণে সরকারের উদ্দেশ্যে বাদ সাধছে অসাধু ব্যবসায়ী ও শিক্ষকদের একটি চক্র। নীলফামারীর সৈয়দপুরে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও সহায়ক বইয়ের নামে নিষিদ্ধ নোট–গাইড কিনতে শিক্ষার্থীদের চাপ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

আইন অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তকের নোটবই প্রকাশনা ও বিক্রি করা নিষিদ্ধ। এ আইন উপেক্ষা করেই সৈয়দপুরের বাজারে অহরহ নোটবই বিক্রি হচ্ছে। অনেকে কৌশলে গাইড-সহায়ক বই আকারে এই বই চালাচ্ছে। নিয়মানুযায়ী, এনসিটিবির অননুমোদিত বই পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা যাবে না। কিন্তু অধিকাংশ স্কুলে পাঠ্যতালিকা (বুকলিস্ট) তৈরিতে নিয়ম ভঙ্গ করা হচ্ছে।

সরকারের শিক্ষা পরিকল্পনায় গাইড বইয়ের কথা বলা না হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু অসাধু শিক্ষক বিভিন্ন ‘শিক্ষক সমিতি’ নামে সংগঠনের ছায়াতলে সিন্ডিকেট তৈরি করে নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের। কেজি স্কুল থেকে শুরু করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবখানেই ওই সিন্ডিকেটের লাখ লাখ টাকার গাইড বাণিজ্য চলছে।

কোন বই পড়ানো হবে, নির্ভর করে ‘ডোনেশনের’ ওপর

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় বই রাখার বিষয়টি নির্ভর করে ডোনেশন (অনুদান) নামে ঘুষের ওপর। পাঠ্যতালিকায় নিজের প্রকাশনীর বই রাখার বিনিময়ে প্রকাশনীগুলোকে শিক্ষক সমিতিকে দিতে হয় বড় অঙ্কের অর্থ। আর শিক্ষক সমিতিকে যদি আয়ত্তে নিতে না পারে, তাহলে শুরু হয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মাধ্যমে বিদ্যালয়ে তাদের প্রকাশনীর বই পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা। সারা বছর দু-একটি করে সৌজন্য সংখ্যার বই দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগসাজশ তৈরি করেন বিভিন্ন গাইড বই প্রকাশনীর প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া সমিতির বাইরের প্রতিটি বিদ্যালয়কে এ জন্য দিতে হয় একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ বা আসবাব। এসব ঘুষ বা অর্থের লেনদেনের অনিয়মের অভিযোগ এখন অহরহ। এর ফলে গাইড বইয়ের মূল্যও চলে গেছে সাধারণ শিক্ষার্থীর নাগালের বাইরে।

এ বছরে নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে নিষিদ্ধ নোট-গাইড বইয়ের অবাধ বাণিজ্য। শিক্ষকদের সহায়তায় গাইড বইয়ের অসাধু চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সরকারিভাবে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হলেও থামানো যায়নি অবৈধ গাইড বইয়ের ব্যবসা। ১৯৮০ সালে বই নিষিদ্ধকরণ আইনে এসব বই ছাপা ও বাজারজাত করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও সরকার এসব প্রকাশনাকে বন্ধ করতে পারেনি।

অভিযোগ রয়েছে, সৈয়দপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ শিক্ষক এসব বই বাজারজাতকরণের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়ে নিচ্ছেন। শিক্ষকেরা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলে ‘শিক্ষক সমিতি’ তৈরি করে নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, কোন স্কুল কোন গাইড বই ব্যবহার করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ক্লাসে বইয়ের তালিকা দিয়ে নির্দিষ্ট প্রকাশনার নোট, গাইড, গ্রামার ও ব্যাকরণ বই কিনতে বলা হয়। ফলে কিছু করার থাকে না। বাধ্য হয়েই তাদের এসব গাইডও সহায়ক বই কিনতে হয়।

এদিকে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সৈয়দপুরের বইয়ের দোকানগুলোতেও দেদার বিক্রি হচ্ছে এসব অবৈধ গাইড বই। বইয়ের দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঞ্জেরী, গ্যালাক্সি, লেকচার, অনুপম, জননী, জুপিটার, আদিল, দিকদর্শন, টেন টিচার পাবলিকেশনসসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর ছাপানো নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। এসব বই অধিকাংশই ভুলে ভরা ও নিম্নমানের। গাইড বইয়ের সিন্ডিকেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধানদের ‘ম্যানেজ’ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভুলে ভরা এসব নিম্নমানের বই। উপজেলার আনাচকানাচে দীর্ঘদিন ধরে নোট ও গাইড বই বিক্রির সিন্ডিকেটের এ বই–বাণিজ্য বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই প্রশাসনের।

শহরের নতুন বাবুপাড়া এলাকার আহমেদা ইয়াসমিন নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘নোট ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের মৌলিক চিন্তা–প্রক্রিয়া ও ভিত্তি গঠনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যার দিকে ধাবিত করে তাদের সৃজনশীলতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি সৈয়দপুর শাখার সম্পাদক নাছিম রেজা শাহ বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। আমরা নই, প্রকাশনীর লোকেরাই এসব গাইড ও নোট ব্যবহারের জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করছেন।’

এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রেহেনা ইয়াসমিন উপজেলার বই বিতানগুলোতে গাইড ও নোট বই বিক্রির কথা স্বীকার করেন। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ওপর থেকে বলা হয়েছে বলে জানান তিনি। 

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পরিমল কুমার সরকার বলেন, অভিযোগ সত্য হলে জড়িত ব৵ক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।