প্রতিমন্ত্রী আসবেন তাই...

মির্জাপুরের বাইমহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক কসরত শেখানো হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়।  ছবি: প্রথম আলো
মির্জাপুরের বাইমহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক কসরত শেখানো হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়। ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা সদরের বাইমহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। এ জন্য তিন দিন ধরে পাঠদান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের শারীরিক কসরতসহ বিভিন্ন কার্যক্রম শেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ঘটনায় বিদ্যালয়টির শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের লাইন সোজা করতে দেরি হওয়ায় চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে গত মঙ্গলবার পেটানো হয় বলে অভিযোগ। এক দিন যেতে না যেতে গতকাল বুধবারও তাকে পেটানো হয়। ছেলেটি এখন প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে।

মো. রুহানুল ইসলাম নামে ওই শিক্ষার্থী বলে, ‘ড্রিল করার সময় লাইন বড় হয়েছিল। আমি বুঝতেই পারি নাই যে আরেকটা লাইন করা লাগবে। তখন হেড ম্যাডাম এসে আমাকে মারল।’

রুহানুলের মা রুনু তালুকদার বলেন, ছেলেটিকে খুবই পেটানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন তাঁর ছেলের মাথায় পানি ঢালেন। পরে ক্লিনিকে নেওয়া হয়।

এর আগে গত বছরের ২৮ নভেম্বর বিদ্যালয়টি প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব পরিদর্শন করেন। এ জন্য প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রেখে শারীরিক কসরত শেখানো হয় বলে অভিযোগ। সে সময় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অভিভাবকদের কেউ মুখ খোলেননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আজ বৃহস্পতিবার প্রতিমন্ত্রী বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে আসবেন। এ জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে বিদ্যালয় সাজানোর কাজ শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে শারীরিক কসরত প্রদর্শনের জন্য প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। তিন দিন আগে থেকে শুরু হওয়া এ কার্যক্রম বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে চলে। তবে গতকাল বুধবার সকালে শুরুর দুই ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীদের বাইমহাটী গ্রামের পালপাড়া এলাকায় একটি খেতে প্রশিক্ষণের জন্য নেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, খেতটিতে শিক্ষার্থীদের দেখভালের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রয়েছেন। কয়েকজন অভিভাবক দূর থেকে দাঁড়িয়ে সন্তানদের দেখছেন।

প্রধান শিক্ষকের পিটুনিতে আহত শিক্ষার্থী রুহানুল ইসলাম।  ছবি: প্রথম আলো
প্রধান শিক্ষকের পিটুনিতে আহত শিক্ষার্থী রুহানুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী জানায়, সারা দিন সেখানে থাকতে হচ্ছে তাদের। সকালে কেউ খেয়ে আসে, কেউ না খেয়ে। দুপুরে কিছু সময় খাওয়ার জন্য বিরতি দেওয়া হয়। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের জন্য খাবার নিয়ে আসেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে খেতে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রসঙ্গে এক শিক্ষক বলেন, ‘তুলসীপাতা দিয়্যা স্কুল ধুইয়ে দিব, তাই।’

অভিভাবকদের কয়েকজন অভিযোগ করেন, শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে ভুল হলে বেত দিয়ে পেটানো হয়। প্রধান শিক্ষক ‘তুই-মুই’ করে গালমন্দ করেন। প্রধান শিক্ষকের ভয়ে অনেকে ঠিকমতো খায়ও না। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে রাত নয়টার আগে বাড়িতে যেতে দেওয়া হয় না।

কত শিক্ষার্থী শারীরিক কসরত প্রদর্শনের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক লাইলী বেগম বলেন, ‘দেখতেছেনই তো।’ সরেজমিনে প্রায় দেড় শ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ নিতে দেখা গেছে।

এর আগে সচিবের আগমনের সময় শিক্ষক লাইলী বেগম জানিয়েছিলেন, শিক্ষার্থীদের দিয়ে নানা ধরনের শারীরিক কসরত প্রদর্শন করা হবে। এ জন্য ড্রিলে ১২০ জন, সাইকেল শোভাযাত্রায় ৪০, প্যারেডে ১২ আর নাচে ৮ থেকে ১০ জন করে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৩০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এবারও একইভাবে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সভাপতি লুৎফর রহমান জানান, প্রতিমন্ত্রী আসার খবরটি তিনি জেনেছেন। কিন্তু তাঁর আগমনে বিদ্যালয়ে কী করা হচ্ছে, তার কিছুই তিনি জানেন না।

>তিন দিন ধরে পাঠদান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের শারীরিক কসরতসহ বিভিন্ন কার্যক্রম শেখানো হচ্ছে।

জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক হোসনে আরা দাবি করেন, ‘আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাছি না। পাঠদান কার্যক্রম করতাছি। ওগলা পড়ার মধ্যে। ৭০ জন আছে। সব পাঠদান কার্যক্রমের ওপরে। সব সমাজ বইয়ের পড়ার ওপরে।’

সমাজ বই কতক্ষণ পড়তে হয়, প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘কী জানি রে ভ্যাই। আমি এত কিছু কইয়্যা হারুম না। পরে কতা কমুনি।’ আপনি সকাল থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শারীরিক কসরত করাচ্ছেন, বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘আমি তো বাচ্চারে শিখাইতাছি। বাচ্চাগো কাজ করাইতাছি। আমার যা দায়িত্ব, আমি তাই পালন করতাছি। আমার কাজ শিক্ষা দেওয়া। আমি শিক্ষক হিসেবে বাচ্চাদের শিক্ষা দিচ্ছি।’

এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও খুব বিরক্ত। স্কুলটিতে প্রোগ্রাম কমিয়ে দেওয়া উচিত। বছরে একটি প্রোগ্রাম হতে পারে। এত ঘন ঘন প্রোগ্রাম করলে বিপদ।’

দুপুরের পর শিক্ষার্থীদের স্কুলের মাঠে আনা হয়। গতকাল রাত নয়টার দিকেও সেখানে শিক্ষার্থীদের কসরত করানো হয়েছে। অভিভাবকেরা বলেন, ‘গতকাল মঙ্গলবার রাত নয়টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের রাখা হয়েছিল। আজও (বুধবার) একই অবস্থা হবে।’

ছাত্রকে মারপিটের বিষয়ে কথা বলতে গতকাল রাতে ফোন করা হলে প্রধান শিক্ষক হোসনে আরা ফোন ধরেননি।