মরণোত্তর অঙ্গদানে আগ্রহ বাড়ছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বছর দুই আগে চাকরিজীবী নজরুল ইসলামের মাথায় আসে, তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান করবেন। এ ভাবনা থেকে তিনি অঙ্গীকারও করেন।

৩৮ বছর বয়সী নজরুলের স্ত্রী আফসানা নাজনীনও (২৫) একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেছেন।

নজরুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিয়মিত রক্ত দিই। একদিন ভাবলাম, মৃত্যুর পর আমার চোখ তো আর কোনো কাজে আসবে না; বরং দান করলে কারও উপকার হবে। কেউ চোখে দেখতে পারবে। মানবিক চিন্তা থেকে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

মরণোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারে দেশের অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণেরা বেশি অঙ্গীকার করছেন। পাশাপাশি কেউ কেউ মরণোত্তর দেহদানেরও অঙ্গীকার করছেন।

চক্ষুদানের ৩৮ হাজার অঙ্গীকার
দেশে অন্ধত্ব মোচনের প্রত্যয় নিয়ে ১৯৮৪ সালে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্ধত্ব মোচন (চক্ষুদান) আইন, ১৯৭৫ অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে। সমিতি সূত্র জানায়, গত ৩৫ বছরে তারা ৪ হাজার ২৮টি কর্নিয়া পেয়েছে। তার মধ্যে ৩ হাজার ১৭টি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত সমিতিতে মরণোত্তর চক্ষুদানের ৩৮ হাজারের বেশি অঙ্গীকার জমা পড়েছে।

সমিতির সমন্বয়ক সাইফুল ইসলাম নিজেও মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘মরণোত্তর চক্ষুদানে যাঁরা অঙ্গীকার করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। এভাবে সবার এগিয়ে আসা উচিত।’

দেহদানের ১২০ অঙ্গীকার
মরণোত্তর দেহদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মৃত্যুঞ্জয়’। ২০১৪ সাল থেকে সংগঠনটি কাজ করছে। সংগঠনটির মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১২০ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন।

গত বছর মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তা নিলুফার রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কলেজজীবন থেকে নিয়মিত রক্ত দিই। অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম মরণোত্তর দেহদান করব। সেটার অঙ্গীকারও করে ফেলেছি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন কিছু না।’

মরণোত্তর দেহদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক অজয় রায়। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুর পরদিন অজয় রায়ের দেহ দান করা হয় বারডেম হাসপাতালে। একই বছরের ৩ জানুয়ারি তাঁর স্ত্রী শেফালি রায়ের মৃত্যুর পর দেহ দান করা হয় মগবাজারের আদ–দ্বীন হাসপাতালে। এই দম্পতির বড় ছেলে অভিজিৎ রায়ের দেহ দান করা হয় ২০১৫ সালে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

মৃত্যুঞ্জয়ের সমন্বয়ক সাগর লোহানী নিজেও মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, মানুষ ভালো কাজে এগিয়ে আসুক। মারা যাওয়ার পর তাঁর দেহ কাজে লাগুক।’

মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে বলেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মানুষের চিকিৎসায় এই জ্ঞান কাজে লাগবে। আমার মতে, দেহ উইল করে দান করা উচিত, যাতে পরিবারের সদস্যরা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।’

চিকিৎসকেরা জানান, মরণোত্তর দেহ মেডিকেল শিক্ষার বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়। চিকিৎসার একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য দেহ ব্যবচ্ছেদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) অ্যানাটমি বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৯৮ সাল থেকে এই হাসপাতালে মরণোত্তর দেহদানের কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত মরণোত্তর দেহদানের আবেদন পড়েছে ৬৫টি। হাসপাতালে ১২টি দেহ আছে। তাঁদের মধ্যে আছে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী, ব্লগার অভিজিৎ রায়, মো. পারভেজ মাসুদ, সীমা রায়, অধ্যাপক নরেণ বিশ্বাস, মৈত্রীয় চট্টোপাধ্যায়ের দেহ।

মরণোত্তর দেহদানে তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে বলে জানান ঢামেকের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হুমায়রা নওশাবা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মরণোত্তর দেহদানের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেশ কয়েক বছর যাবৎ শুরু হয়েছে। আগে এ নিয়ে তেমন সাড়া পাওয়া যেত না। আমরা তালিকা করে দেখেছি, তরুণদের মধ্যে এই আগ্রহ বেশি।’

তবে অধ্যাপক হুমায়রা নওশাবা বলেন, দেহদানের অঙ্গীকার যে পরিমাণ হয়, শেষ পর্যন্ত তা পাওয়া যায় না। দেখা যায়, স্বজনেরা হয় তো চান না।

মরণোত্তর দেহ সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। এ সংখ্যা ১৫। এখানে আছে ভাষাসৈনিক বেলাল মোহাম্মদ, সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পঙ্কজ ব্যানার্জি, নোয়াখালী গান্ধী আশ্রমের ঝর্ণাধারা চৌধুরী ও শিখা ব্যানার্জির দেহ।

বিএসএমএমইউ অ্যানাটমি বিভাগের অফিস সহকারী আবদুর রহিম জানান, ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৮ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন।

বিএসএমএমইউর অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক খন্দকার মানজারে শামীম নিজেও মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেন, যাঁরা মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করছেন, তাঁরা বয়সে তরুণ।

যেভাবে দেহ দান করবেন
মরণোত্তর দেহদান করতে চাইলে যেকোনো মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতালের অধ্যক্ষ বা পরিচালক বরাবর একটি আবেদন করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে স্ট্যাম্প কাগজে হলফনামা, দুই কপি সত্যায়িত পাসপোর্ট ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি লাগবে। অঙ্গীকারনামায় দেহদানকারী, গ্রহীতা ও সাক্ষীদের নাম–ঠিকানা উল্লেখ থাকে। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সম্মতি নিতে হয়। গত হওয়ার পর স্বজনদের হাসপাতালে দেহ পৌঁছে দিতে হয়। সঙ্গে ডেথ সার্টিফিকেটের কাগজ রাখতে হয়।