শুধু আগুন লাগলেই সরব

আগুনে জ্বলছে ওয়াহেদ ম্যানশন।  ফাইল ছবি
আগুনে জ্বলছে ওয়াহেদ ম্যানশন। ফাইল ছবি

পুরান ঢাকার কে বি উর্দু রোডের ঘিঞ্জি গলিতে নোয়াখালী বিল্ডিং। তার চারদিক ঘিরে ছোট্ট ছোট্ট ঘুপচি ঘর। পোড়া–ঝাঁজালো গন্ধ ছড়াচ্ছে এসব ঘর থেকে। ঘরগুলোর ভেতরে পুরোনো প্লাস্টিকসামগ্রী গলিয়ে দানা ও প্লাস্টিক সরঞ্জাম তৈরি হচ্ছে। কারখানায় বসানো যন্ত্রে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ। কারিগরেরাও বলছেন, যেকোনো সময় এখানে আগুন ধরে যেতে পারে। 

কে বি উর্দু রোডই নয়, পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, আরমানিটোলা, ইমামগঞ্জ, ইসলামবাগ, মিটফোর্ড, কোতোয়ালি ও হাজারীবাগে বাড়িতে বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম, রাবারের স্যান্ডেল ও প্লাস্টিকের কারখানা। লাখ লাখ মানুষ এমন ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর কর্তৃপক্ষ সরব হয়। কিন্তু কিছুদিন গেলেই তারা নীরব হয়ে যায়। যে কারণে এই এলাকা থেকে কারখানা ও গুদাম সরে না। অবশ্য এলাকার মানুষও সেটা চায় না। বেশির ভাগ মানুষ কারখানা ও গুদাম রাখার পক্ষে। 

 ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অস্থায়ী গুদামগুলো ঢাকার কাছে টঙ্গী ও রাজধানীর শ্যামপুরের শিল্প এলাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে এসব গুদাম স্থায়ীভাবে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে নিতে ৩১০ একর জমি বরাদ্দ করেছে সরকার। কিন্তু সেই কাজের অগ্রগতি নেই। গুদাম আর সরেনি। 

গত শনি ও রোববার পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, আরমানিটোলা, ইমামগঞ্জ, ইসলামবাগ, মিটফোর্ড ও কোতোয়ালি এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ বাড়ির নিচতলায় রয়েছে গুদাম ও কারখানা। তার ওপরে মানুষের বসবাস। আবাসিক এলাকা হলেও গলিপথ সরু। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার মতো কোনো জায়গা নেই। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও নেই।

ইসলামবাগের বাসিন্দা আহমেদুল হাসান বলেন, এলাকায় গড়ে উঠেছে প্লাস্টিক ও স্যান্ডেল-জুতা তৈরির কারখানা। এসব পণ্যের কাঁচামাল যেমন—বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিকের গুটি, রং ইত্যাদির দোকান এবং গুদামও রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ভাঙারি প্লাস্টিকের গুদাম, প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ কারখানা, ইমিটেশনের গয়না, লেদ মেশিন ও তারকাঁটা তৈরির কারখানাও। এগুলো বেশির ভাগেরই অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নেই বললেই চলে। 

ইমামগঞ্জের বাসিন্দা শাহাবুদ্দীন বলেন, ‘আগুনে আজ একটি কারখানা পুড়ল। কাল হয়তো অন্য কোথাও লাগবে। এই লাগার পরেই আবাসিক এলাকা থেকে কারখানা উঠিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হবে। এরপর কয়েক দিন পর সব থেমে যাবে।’ তিনি বলেন, নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনের পর এখন তাঁদের দিন কাটে আতঙ্কে। 

রাসায়নিক আমদানি ও গুদামজাত করতে হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক প্রথম আলোকে বলেন, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামের কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তবে প্লাস্টিক বা রাবারের কারখানা করার ক্ষেত্রে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হয় না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সূত্র জানায়, পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম ও দাহ্য বস্তুর কারখানার সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার রয়েছে বাসাবাড়িতে। গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসেপ্রোইলসহ ভয়ংকর রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ। এসব রাসায়নিক সামান্য আগুনের স্পর্শ পেলেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। 

জানতে চাইলে বাপার সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সরকারের তৎপরতা শুরু হয়, তদন্ত কমিটি হয়। এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয় না। 

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড রোডে দেখা যায়, স্থানীয় মমতাজ মার্কেটের সামনে সারি সারি রাসায়নিকের ড্রাম। শ্রমিকেরা মার্কেট থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাম বহন করে বিভিন্ন পরিবহনে তুলছেন। ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, তাঁদের এখানে রাসায়নিক গুদাম নেই। এখানে তাঁদের ১ হাজার ২০০ শোরুম আছে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারী মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাসায়নিক গুদাম নিয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক রয়েছে। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিক গুদামের জন্য জায়গা প্রস্তুত না হওয়ায় সেখানে তা সরিয়ে নেওয়া যায়নি। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার বলেন, চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার পর রাসায়নিক গুদামের ট্রেড লাইসেন্স নতুন করে নবায়ন করা হয়নি। এমনকি রাসায়নিক গুদামের কোনো লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। 

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অভিযান) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকায় বেশির ভাগ ভবনে অগ্নিনর্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। যেগুলোতে আছে তাও অচল।