বিপদ বাড়াবে নতুন ইমারত বিধিমালা

যখনই বড় কোনো আগুনের ঘটনা ঘটে, তখন অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। ফাইল ছবি
যখনই বড় কোনো আগুনের ঘটনা ঘটে, তখন অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। ফাইল ছবি

সরকার নতুন যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা করতে যাচ্ছে, তাতে ঢাকা মহানগরসহ দেশের বড় শহরগুলোর মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলার বন্দোবস্ত প্রায় চূড়ান্ত। ১০ তলা পর্যন্ত ভবনে বাধ্যতামূলকভাবে স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা (অ্যালার্ম) থাকার যে নিয়ম রয়েছে, নতুন বিধিমালায় তা আর বাধ্যতামূলক থাকছে না। এর পরিবর্তে চাইলেই হাতে চালিত ঘণ্টি বাজাতে পারবেন ভবন তত্ত্বাবধায়কেরা। ২৪ তলা ভবন পর্যন্ত এমন শিথিলতা রাখা হয়েছে।

যখনই বড় কোনো আগুনের ঘটনা ঘটে, তখন অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। গত বছর এই দিনে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনে মৃত্যু হয় ৭০ জনের। তখনো অগ্নিনিরাপত্তার দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।

জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০২০-এর অগ্নি নিরাপত্তা অংশে এমন আরও কিছু শর্ত শিথিল করা হয়েছে, যা বিপদের কারণ হবে বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা। যেমন, ৮০ মিটার উঁচু (২৪ তলা) বাণিজ্যিক ভবনেও বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (পোর্টেবল ফায়ার এক্সটিংগুইশার) অথবা হাইড্রেন্ট (যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়) ব্যবহার করলেই চলবে বলা হচ্ছে। যদিও এর একটি আরেকটির বিকল্প হতে পারে না।

প্রস্তাবিত এই বিধিমালার ‘আগুন’ অধ্যায় প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক হলেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপপরিচালক সোলায়মান চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যেভাবে অগ্নিনিরাপত্তার কথা লিখেছিলেন, সেভাবে বিধিমালা হয়নি। তাঁরা লিখিত আপত্তি জানিয়েছেন। সোলায়মান চৌধুরী বলেন, অপরিবর্তিত অবস্থায় যদি বিধিমালাটি পাস হয়ে যায়, তাহলে দেশে আর একটি পাঁচ তারকা হোটেলও থাকবে না। পাঁচ তারকা হোটেলে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত মানার বাধ্যবাধকতা আছে। তবে খোঁজখবর করে জানা গেছে, সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বিধিমালাটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে (আইনি যাচাই-বাছাই) রয়েছে। 

সর্বশেষ ১৮ ফেব্রুয়ারি এ সম্পর্কিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্র জানাচ্ছে, এ মাসের শেষ নাগাদ বিধিমালাটির প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।

জাতীয় বিল্ডিং কোড স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যসচিব হলেন হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ শামীম আখতার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত যেভাবে বিধিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছে, সেভাবেই অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে। পরের বিধিমালায় উদ্বেগের বিষয়গুলো যেন আর না থাকে, সে চেষ্টা করা হবে।

যে যে জায়গায় পরিবর্তন আসছে 
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ এবং জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী ২০ মিটারের চেয়ে উঁচু (ছয়তলা) ভবনকে বহুতল ভবন বলা হয়। এর আওতায় আবাসিক ও অনাবাসিক ভবনগুলোকে বেশ কিছু শর্ত মানতে হয়। যেমন ভবনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধোঁয়া বা তাপমাত্রা শনাক্তকরণ ব্যবস্থা রাখা, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা থাকা (স্প্রিংকলার), ন্যূনতম ১৭ হাজার গ্যালন পানি ধারণক্ষম জলাধার এবং জলাধার থেকে যেন পানি নেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা, ফায়ার ফাইটিং পাম্পহাউস (বিদ্যুৎ, ডিজেল বা বাষ্পচালিত পাম্প যা জলাধার থেকে পানি সংগ্রহ করে ও সরবরাহ করে), জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ও ফ্লোরে আলোর ব্যবস্থা, বিকল্প সিঁড়ি, ফায়ার লিফট এবং রিফিউজ এরিয়া অর্থাৎ আগুন, তাপ ও ধোঁয়ামুক্ত নিরাপদ এলাকা থাকতে হবে। এই শর্তগুলো মানলেই কেবল কোনো ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র পেতে পারে। প্রস্তাবিত আইনে ১০ তলা পর্যন্ত এই ব্যবস্থাগুলো থাকার বাধ্যবাধকতা আর থাকছে না।

বিদ্যমান বিধিমালায় ২০ মিটারের বেশি উচ্চতার ভবনে স্বয়ংক্রিয় ও হাতে চালানো ফায়ার অ্যালার্ম থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। প্রস্তাবিত বিধিমালায় হাতে চালানো অথবা স্বয়ংক্রিয় ফায়ার অ্যালার্মের কথা বলা হয়, যা ৮০ মিটার (২৪ তলা) উঁচু বাণিজ্যিক ভবনের জন্যও প্রযোজ্য। 

বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (পোর্টেবল ফায়ার এক্সটিংগুইশার) এবং হাইড্রেন্ট—এ দুটো ব্যবস্থার যেকোনো একটি রাখার কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্সটিংগুইশার দুই ধরনের। একটি থেকে পানি ছিটিয়ে আগুনের তাপ কমানো হয়, অন্যটি থেকে ড্রাই পাউডার ছিটানো হয়। আর হাইড্রেন্ট ব্যবস্থায় জরুরি প্রয়োজনে জমা থাকা পানি হোসপাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় এবং আগুন নেভানো হয়। তাই এক্সটিংগুইশার ও হাইড্রেন্ট একে অন্যের বিকল্প হতে পারে না। 

নতুন বিধিমালায় ডিজেল (কমপ্রেশন ইগনিশন ইঞ্জিন) চালিত স্বয়ংক্রিয় পাম্প বাদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নিজস্ব জেনারেটরে চলা ইলেকট্রিক পাম্পের ব্যবস্থা রাখতে। যাঁরা এই নীতিমালায় পরিবর্তনের দাবি করছেন তাঁদের মত হলো, আগুন লাগলেই প্রথমে বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ করা হয়। ইলেকট্রিক পাম্প অচল থাকলে পানি ওঠানো সম্ভব নয়। আর পানি না থাকলে হোসপাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করাও অসম্ভব। 

স্প্রিংকলার ব্যবস্থা আগুন নেভানোর জন্য খুব কার্যকর একটি পদ্ধতি। আন্তর্জাতিক ফায়ার কোড অনুযায়ী ১২ হাজার বর্গফুট আয়তনের বা ৫৫ ফুট উচ্চতার বেশি যেকোনো ভবনে স্প্রিংকলার অত্যাবশ্যক। প্রস্তাবিত বিধিমালায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদউল্লা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালা পরিবর্তনযোগ্য। আপাতত এই নীতিমালা কার্যকর করার পরিকল্পনা আছে, পরে সংস্কার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, বিকল্প বা ‘অথবা’র যে বিষয়টি তা হলো, যাঁরা বহুতল ভবনের নকশার অনুমোদন দেবেন, তাঁদের অবশ্যই ভবনের নকশা অনুযায়ী কী ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে, তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। অর্থাৎ, যেখানে জলাধার রাখা প্রয়োজন সেখানে জলাধারই রাখতে হবে, সেখানে শুধু অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রেখে নকশা অনুমোদন করানো যাবে না।

বাণিজ্যের অভিযোগও আছে
বিধিমালা প্রণয়নে গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির একজন সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিকল্প একটু বেশি রাখা হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। তবে নীতিমালার উদ্দেশ্য হলো একটা মানদণ্ড ঠিক করা। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ছয়তলার ওপরে ভবনকে বহুতল বলছে তার পেছনে অন্যতম কারণ, এতে করে কয়েক লাখ ভবন ছাড়পত্রের জন্য যাবে। ১০ তলার ওপর ভবনের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা দুই-আড়াই হাজারে নেমে আসবে। তা ছাড়া যাঁরা নতুন বিধিমালায় অগ্নিনিরাপত্তা অংশের সঙ্গে একমত নন, তাঁদের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। 

তবে ফায়ার সার্ভিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বিধিমালা অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩-এর পরিপন্থী। অগ্নিনিরাপত্তায় যে ব্যবস্থাগুলোর কথা আগে বলা হয়েছিল, সেগুলো ব্যয়বহুল সত্য। কারণ, বাংলাদেশ এসব জিনিস কেনাকাটা করে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান থেকে। এখন এর ভালো বিকল্প আছে; দুবাই বা চীনের যন্ত্রপাতির দাম ইউরোপের তুলনায় অনেক কম। কাজেই ব্যবসা-বাণিজ্যের যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা সত্য নয়।

কমিটিতে কারা
বিধিমালাটি প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। এতে কাজ করেছে মোট তিনটি কমিটি। প্রথম ধাপে স্টিয়ারিং কমিটি, দ্বিতীয় ধাপে এডিটর্স কমিটি ও তৃতীয় ধাপে রাইটার্স কমিটি বা পরামর্শক কমিটি। পরামর্শক হিসেবে ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বুয়েটের গবেষণা সংস্থা ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশন।

স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি। এর বাইরে কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের তিনজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস, আর্কিটেকচার এবং আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক, পূর্ত বিভাগের পাঁচজন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তিনজন, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তিনজন, পরিবেশ বিভাগের তিনজন এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) দুজন প্রতিনিধি।

উদ্বেগ
ফায়ার সেফটি কনসালট্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. হাশমতুজজামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন এই বিধিমালার অগ্নিনিরাপত্তা অংশ যদি অপরিবর্তিত অবস্থায় পাস হয়, আমি বলব তাতে করে বহু মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। আমরা মন্ত্রী, সচিবসহ কমপক্ষে ৩০টি জায়গায় আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। অজ্ঞাত কারণে কেউ সাড়া দিচ্ছেন না।’