একযোগে জানানো হবে শ্রদ্ধা

সখীপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাকার্থা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে স্থাপিত শহীদ মিনারটির নির্মাণকাজ গত বুধবার শেষ হয়েছে।  ছবি: প্রথম আলো
সখীপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাকার্থা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে স্থাপিত শহীদ মিনারটির নির্মাণকাজ গত বুধবার শেষ হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

আজ শুক্রবার মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। টাঙ্গাইলের সখীপুরে এই প্রথম প্রায় ২২ হাজার খুদে শিক্ষার্থী তাদের নিজ বিদ্যালয় চত্বরে স্থাপিত শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার উপজেলার ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। শহীদ মিনার নির্মাণে সরকারি বরাদ্দ না থাকলেও স্থানীয় লোকজন, শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের টাকায় শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ইউইও) মানবেন্দ্র দাস এ তথ্য জানিয়েছেন।

সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শামীম আল মাসুদ রানা জানান, ২০১৮ সালের আগে উপজেলায় মাত্র ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার ছিল। ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, সখীপুরে ১৩৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই। খবরটি তাঁকে খুবই পীড়া দেয়। এরপর সখীপুরের সব বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের চিন্তা করতে থাকেন। ‘আমাদের বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার আমরাই গড়ব’ স্লোগান নিয়ে শুরু হয় তাঁর শহীদ মিনার স্থাপনের আন্দোলন। তাঁর ক্লাস্টারের আওতায় ৫৫টি বিদ্যালয়ে ২০১৮ সালেই শহীদ মিনার স্থাপন করেন তিনি।

সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা শামীম আল মাসুদ জানান, এরপর ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আবার কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে শিরোনাম হয়, ‘সখীপুরে ৭১ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই’, কিন্তু তিনি তো সারা উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নন। তিনি তাঁর ভাবনার কথাটি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মানবেন্দ্র দাসকে জানান। তিনি তাঁকে দারুণভাবে সাহস জোগান ও সহায়তা করেন। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই উপজেলার ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তাঁরা যেকোনোভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ করবেন। তারপর মাসিক সভায় উপজেলার সব প্রধান শিক্ষককে বলে দেওয়া হয় প্রতিটি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণের কথা।

উপজেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, কীভাবে শহীদ মিনারের জন্য টাকা জোগাতে তহবিল করা হবে, বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তাঁদের বুঝিয়ে দেন। বলেন, তাঁরা বিদ্যালয়ে গিয়ে ম্যানেজিং কমিটি, সহকারী শিক্ষক ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে সভা করবেন। বিশেষ করে প্রবাসী যাঁরা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের সহযোগিতা নেওয়ার কথা বলেন। প্রবাসীদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য করা তহবিলে দান করার বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে বলা হয়। তিনি এ–ও বলে দেন, কারোর কাছ থেকে চাপ দিয়ে বা জোরজবরদস্তি করে টাকা নেওয়া যাবে না। যেমন কথা তেমন কাজ। কয়েক মাসের মধ্যেই শুরু হয় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য আন্দোলন। এভাবেই গত এক বছরে উপজেলার ৭১টি বিদ্যালয়ে নতুনভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের মধ্য দিয়ে এখন ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।

>উপজেলার ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের টাকায় শহীদ মিনার নির্মাণ সম্পন্ন।

উপজেলার পশ্চিম বোয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কোহিনুর আখতার বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষক। তাঁরা ৮–৯ মাস ধরে বেতন থেকে কিছু কিছু টাকা আলাদা করে জমাতে থাকেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তহবিলে ১৫ হাজার টাকা জমে যায়। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আবদুর রশিদ তাঁদের উদ্যোগের কথা জেনে তিনিও ১০ হাজার টাকা দেন। ২৫ হাজার টাকা হাতে নিয়ে বিদ্যালয়ের মাঠের এক কোণে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ইতিমধ্যে কিছু অভিভাবক তাঁদের সাধ্যমতো অংশ নেন। এভাবেই শহীদ মিনারটির নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।

উপজেলা কাঁকড়াজান ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে হামিদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মো. ইব্রাহিম খলিল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনিও শোনালেন তাঁর বিদ্যালয়ে নির্মিত শহীদ মিনার স্থাপনের গল্প। বলেন, হামিদপুর গ্রামের আবদুস সবুরের ছেলে লোকমান হোসেন দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকেন। লোকমান বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। লোকমানকে ফোনে বলা হয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য গঠিত তহবিলে সহযোগিতা করার জন্য। লোকমান জানিয়ে দেন, তিনি শহীদ মিনার নির্মাণের সব ব্যয় একাই বহন করবেন। লোকমানের দেওয়া ৫৬ হাজার টাকা ব্যয়ে দুই মাস আগেই শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শেষ হয়।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মানবেন্দ্র দাস জানান, শিক্ষা কার্যালয়ের আন্তরিকতার কারণেই উপজেলার সব কটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার স্থাপন সম্ভব হয়েছে। শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সদস্য, অভিভাবক সদস্য, স্থানীয় লোকজন ও প্রবাসীরা সহযোগিতা করায় কাজটি শতভাগ সফল হয়েছে।

মানবেন্দ্র দাস বলেন, ‘আমার ধারণা, সখীপুর ছাড়া বাংলাদেশের কোনো উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ শহীদ মিনার নেই। আমাদের পরিশ্রম, আমাদের স্বপ্ন সত্যি সত্যি সফল হতে চলেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভোরে উপজেলার ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২২ হাজার ৭৩৪ জন খুদে শিক্ষার্থী ও ৭৫০ জন শিক্ষক ভাষাশহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন।’

সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আমিনুর রহমান বলেন, টাঙ্গাইলের মধ্যে সখীপুর উপজেলাই ব্যতিক্রম। উপজেলার ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে এবার একযোগে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। এতে সখীপুর উপজেলার মর্যাদা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে।