অপুষ্টি কমাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক, পাশে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ ও গেইনের নির্বাহী পরিচালক লরেন্স হাদ্দাদ। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক, পাশে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ ও গেইনের নির্বাহী পরিচালক লরেন্স হাদ্দাদ। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার খাদ্য ও পুষ্টিবিষয়ক অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সরকার কাজ করে চলেছে। অপুষ্টির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বার্ষিক সাত হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। অপুষ্টির হার কমানো এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য উন্নয়ন-সহযোগী, বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব বক্তব্য উঠে আসে। ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি): খাদ্য ও পুষ্টি প্রতিশ্রুতি’ শীর্ষক বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো। এতে সহযোগিতা করে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন)।

বৈঠকের প্রধান অতিথি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাংসদ মুজিবুল হক বলেন, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি করতে সরকার বদ্ধপরিকর। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতিকে আগামী অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন ও সঞ্চালনা করেন গেইনের নির্বাহী পরিচালক লরেন্স হাদ্দাদ। তাতে বলা হয়, বিশ্বে প্রতি তিনজনের একজন অপুষ্টিতে ভুগছেন। অপুষ্টির ফলে ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। ব্যক্তির আয় বাড়লেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাবারের মান উন্নত হয় না। উন্নত খাবার নিশ্চিত করতে হলে সব পর্যায়ে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। 

বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারউয়ে বলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা (ডেল্টা প্ল্যান) ২১০০ অনুযায়ী কৃষি খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করবে নেদারল্যান্ডস। 

সরকার দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ। তিনি বলেন, দারিদ্র্য ও অপুষ্টির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ আগের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রুহুল আমিন তালুকদার বলেন, টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে খাদ্যব্যবস্থা, খাদ্যনিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অনেক চ্যালেঞ্জ। সীমিত সম্পদ নিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই মূল কাজ। 

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য নীতি ও মূল্যায়ন ইউনিটের মহাপরিচালক বদরুল আরেফিন বলেন, সবার জন্য সব সময় নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। ইশতেহারের এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ‘খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি’ নেওয়া হচ্ছে। 

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক শাহ নেওয়াজ বলেন, পুষ্টি কার্যক্রমের সঙ্গে ২২টি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে ৪টি মন্ত্রণালয় ২০টির মতো প্রকল্প চালাচ্ছে। অর্থ ব্যয় হচ্ছে কিন্তু সেটি কি সঠিক পদ্ধতিতে, সঠিক ব্যক্তিদের জন্য ব্যয় হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুস সাত্তার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় অপুষ্টিজনিত সমস্যা বেশি। এসব এলাকায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাসিন্দারা জুমচাষে অভ্যস্ত, তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য।

পুষ্টি বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের লাইন ডিরেক্টর এস এম মোস্তাফিজুর রহমান। 

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ রিচার্ড রেগান বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দুপুরে পুষ্টিকর খাবার দিতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পুষ্টি নিশ্চিত করাও জরুরি। 

‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি): খাদ্য ও পুষ্টি প্রতিশ্রুতি’ শীর্ষক বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো। এতে সহযোগিতা করে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন)। ছবি: প্রথম আলো
‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি): খাদ্য ও পুষ্টি প্রতিশ্রুতি’ শীর্ষক বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো। এতে সহযোগিতা করে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন)। ছবি: প্রথম আলো

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য উঠতি হুমকি বলে মনে করেন জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ রবার্ট সিম্পসন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দলপ্রধান ফার্নহলজ মানফ্রেড পুষ্টির সার্বিক উন্নয়নে বহুখাতভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন।

ইউনিসেফের পুষ্টি বিভাগের প্রধান পিয়ালি মুস্তাফি শিশু ও কৈশোরকালীন সময়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। অ্যালাইভ অ্যান্ড থ্রাইভের কান্ট্রি ম্যানেজার জেবা মাহমুদ নবজাতক শিশুসহ সবার জন্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সহযোগিতার কথা বলেন।

বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইফতেখার রশিদ, এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক খালেদুজ্জামান, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদিন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইউএসএআইডির কৃষি কর্মকর্তা রয় ফেন, এফএওর জ্যেষ্ঠ পুষ্টিবিদ ললিতা ভট্টাচার্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার আসুন্তা টেস্তা প্রমুখ। প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে বৈঠকটি শেষ হয়।