একুশের সংকলন

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু শব্দ। সেসব নিছক শব্দ নয়, ভাষা আন্দোলনের মর্মে গাঁথা প্রতীক। সেই প্রতীকগুলোর কথা। আজ অষ্টম কিস্তি।

দুই বন্ধুর মধ্যে এই মিল হয়তো কাকতালীয়। কিন্তু তা তো মিথ্যা নয়। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে মারা গেলেন হাসান হাফিজুর রহমান। আর সে বছরেরই ৩১ ডিসেম্বর চলে গেলেন মোহাম্মদ সুলতান। অনেক ঝড়–ঝাপটার মধ্যেও এই দুজনের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। হাসান হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর লাশের প্রতীক্ষায় থাকার সময় গাজীউল হককে মোহাম্মদ সুলতান বলেছিলেন, ‘আরেকটি একুশ কি দেখব?’ না, তিনি আরেকটি একুশ দেখেননি।

হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘পুঁথিপত্র প্রকাশনী’ থেকে। আগে এটি ছিল মার্কসবাদী বইয়ের দোকান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই দেখে দোকানটির নাম দেওয়া হয়। মোহাম্মদ সুলতান এবং এম আর আখতার মুকুল মিলে শুরু করেন দোকানটি, যা ছিল বকশীবাজারে। ছোট্ট একটি দোকান। কিছুদিনের মধ্যেই পরামর্শদাতা হিসেবে তাতে যোগ দেন হাসান হাফিজুর রহমান। এম আর আখতার মুকুল বেশিদিন যুক্ত ছিলেন না প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। 

১৯৫৩ সালে ভাষাশহীদদের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারী প্রকাশের মধ্য দিয়েই ‘পুঁথিপত্র’ হয়ে ওঠে প্রকাশনী। লেখাগুলো হাসান হাফিজুর রহমান জোগাড় করেছিলেন প্রায় একক প্রচেষ্টায়। দেরি করায় শুধু আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর কবিতাটি তুলে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ সুলতানের হাতে। এ সংকলনে যাঁদের লেখা ছাপা হয়েছিল, তাঁরা হলেন আলী আশরাফ, শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, আতোয়ার রহমান, মুর্তজা বশীর, সালেহ আহমদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন, কবিরউদ্দিন আহমদ।

সংকলনটির প্রিন্টার্স লাইনে লেখা ছিল, পুঁথিপত্র প্রকাশনীর পক্ষ থেকে মোহাম্মদ সুলতান এটি প্রকাশ করেছেন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমিনুল ইসলাম। রেখাঙ্কন করেছেন মুর্তজা বশীর ও অন্যান্য। পাইওনিয়ার প্রেসের পক্ষে এম এ মুকিত ছেপেছেন। ব্লক তৈরি করেছে এইচম্যান কোম্পানী, বাদামতলী, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ মার্চ ১৯৫৩। দাম দুই টাকা আট আনা।

বইটির উৎসর্গপত্রে রয়েছে, ‘যে অমর দেশবাসীর মধ্যে থেকে জন্ম নিয়েছেন একুশের শহীদেরা, যে অমর দেশবাসীর মধ্যে অটুট হয়ে রয়েছে একুশের প্রতিজ্ঞা—তাদের উদ্দেশ্যে’। সেটা ছিল আনিসুজ্জামানের হাতের লেখায়। ‘পুঁথিপত্র’ লোগোটিও তৈরি করেছিলেন মুর্তজা বশীর। বইটি ছিল ক্রাউন সাইজে। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৮৩।

প্রিন্টার্স রেখাঙ্কনের স্থানে দেখা যাচ্ছে লেখা আছে মুর্তজা বশীর ও অন্যান্য। এই ‘অন্যান্য’ হচ্ছেন বিজন চৌধুরী। একুশে ফেব্রুয়ারীতে মুর্তজা বশীরের সঙ্গে স্কেচ করেছিলেন অগ্রজ শিল্পী বিজন চৌধুরী। এ ব্যাপারে মুর্তজা বশীর জানিয়েছেন, প্রথম যে লিনোকাটটি তিনি এঁকেছেন, সেটি একুশের স্মৃতি দগদগে থাকার সময়টিতেই। অন্যগুলো করা হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের জন্য পরে। বিজন চৌধুরীর নাম দেওয়া সম্ভব হয়নি সম্ভবত এ কারণে যে তখন কমিউনিস্ট, অমুসলমান ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিল খুবই স্পর্শকাতর।

একুশে ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মোহাম্মদ সুলতানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক লিখছেন, ‘ভাষা আন্দোলন, বিশেষ করে একুশের চেতনাধৃত কবিতা, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি নিয়ে মুর্তজা বশীরের স্কেচশোভিত এ সংকলন নানা দিক বিচারে ঐতিহাসিক মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। আর এ সংকলনের প্রতিবাদী চরিত্রের কারণে, সম্ভবত প্রকাশক হিসাবে যুবলীগ নেতার সংশ্লিষ্টতার কারণে, সর্বোপরি এর পাঠকপ্রিয়তার কারণে যথারীতি প্রকাশকের আস্তানায় পুলিশের তল্লাশি এবং শেষ পর্যন্ত সংকলনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।’