চার বছরে সাত হাজার গাছ সাবাড়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ থেকে নির্বিচারে সাবাড় হচ্ছে গাছ। পাহাড় কেটে তৈরি করা হয় রাস্তা। সম্প্রতি ক্যাম্পাসে জীববিজ্ঞান অনুষদের পেছনের পাহাড়ে।  ছবি: সুজয় চৌধুরী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ থেকে নির্বিচারে সাবাড় হচ্ছে গাছ। পাহাড় কেটে তৈরি করা হয় রাস্তা। সম্প্রতি ক্যাম্পাসে জীববিজ্ঞান অনুষদের পেছনের পাহাড়ে। ছবি: সুজয় চৌধুরী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এক অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ক্যাম্পাস। সবুজ পাহাড়, পুকুর, গিরিপথ, বন আর দিগন্তজোড়া মাঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের পাহাড় থেকে নির্বিচার গাছ কাটার কারণে সবুজের এই সমারোহ হুমকির মুখে পড়েছে। গত চার বছরে কেটে সাবাড় করা হয়েছে সাত হাজারের অধিক গাছ। সেগুলো পরিবহনের জন্য পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা।

নিয়মিত গাছ কাটা ও পরিবহনে যুক্ত শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগেও গাছ কাটা হতো। চার বছর আগে রাস্তা তৈরি করার পর গাছ কাটা বেড়ে গেছে। দিনে গড়ে পাঁচটি গাছ কাটা হচ্ছে। এই হিসাবে গত চার বছরে গাছ কাটা হয়েছে সাত হাজার তিন শর মতো। এসব গাছ মূলত চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রতিনিয়ত নানা প্রজাতির গাছ কাটার ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে এখানকার জীববৈচিত্র্যও। কিন্তু এ ব্যাপারে বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ—কারও কোনো পদক্ষেপ নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, গাছ কাটার পর তা পরিবহনের জন্য স্তূপ করে রাখা হয় জীববিজ্ঞান অনুষদের পুকুরপাড় ও কলা অনুষদের ঝুপড়িতে। জীববিজ্ঞান অনুষদের পশ্চিমেপ্রায় পাঁচ কিলোমিটার জায়গায় পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রান্তে এখনো সীমানা নির্ধারিত হয়নি। এর সুযোগ নিয়ে স্থানীয় লোকজন পাহাড়ের গাছ কেটে নিচ্ছেন বলে দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছু কর্তাব্যক্তি এর সঙ্গে জড়িত। তাই বাধা না দিয়ে তাঁরা উল্টো গাছ পরিবহনের অনুমতি দিচ্ছে।

অনুমতিতে বের হয় কাটা গাছ

গত চার বছরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসের মূল ফটক দিয়ে কাটা গাছ বের করার অনুমতি নেন মো. বজল নামে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর এলাকার এক ব্যক্তি। সর্বশেষ গত বছরের ৩১ অক্টোবর মো. বজল ক্যাম্পাসের দক্ষিণ দিকের পাহাড়তলী এলাকা থেকে নিজের বাগানের গাছ দাবি করে দুই হাজার টুকরা আকাশি ও মেহগনি কেটে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেন। এই অনুমতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি (এস্টেট) শাখা ও নিরাপত্তা দপ্তর। এর আগে গত বছরের ১৬ জানুয়ারি তিনি পশ্চিম দিকের নশাবনপাহাড়ি এলাকা থেকে গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেন।

গাছ কাটার কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন মোহাম্মদ বজল। তিনি দাবি করেন, বজ্রপাত ও বন্যার কারণে মরে যাওয়া গাছগুলো কাটা হয়। পাহাড়ে বেশির ভাগ গাছ গ্রামবাসী লাগিয়েছে। সেগুলোই কাটা হচ্ছে।

বজল ছাড়াও এই গাছ কাটায় জড়িত আছেন মো. হানিফ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে যুবলীগের নেতা দাবি করলেও কোনো কমিটিতে তাঁর নাম নেই। এই হানিফও দাবি করেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন গাছ তাঁরা কেটে নিচ্ছেন।

পাহাড় থেকে কেটে রাখা হয়েছে গাছ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।  ছবি: প্রথম আলো
পাহাড় থেকে কেটে রাখা হয়েছে গাছ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ছবি: প্রথম আলো

এঁদের দাবি সঠিক নয় বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন সহকারী প্রক্টর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, সীমানা চূড়ান্ত না হওয়ার সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা থেকেই গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

গত ২৪ নভেম্বর ২০ মণ কাটা গাছ নিয়ে যাওয়ার সময় একটি জিপ গাড়ি (স্থানীয়ভাবে চান্দের গাড়ি নামে পরিচিত) আটক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হকের ফোনে সেই গাড়ি ছেড়ে দিতে হয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী প্রক্টর। ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি এ রকম ফোন কাউকে করেননি।

গাছ কাটায় নিযুক্ত ৪০ শ্রমিক

জীববিজ্ঞান অনুষদের পুকুরপাড় থেকে পশ্চিমের পাহাড়ি এলাকায় সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। এসব গাছের মধ্যে গামারিগাছ, আমগাছ, শিলকড়ইগাছও রয়েছে। দুই গ্রুপে১০ জন শ্রমিককে দেখা যায় গাছ কাটছে। তাঁরা জানান, তাঁরা সবাই স্থানীয় বাসিন্দা। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে গাছ কাটেন। এমন প্রায় ৪০ জন শ্রমিক আছেন পাহাড়ে গাছ কাটেন।

রিয়ন চাকমা নামের একজন বলেন, ​তাঁদের গ্রুপের চারজন আছেন। তাঁদের প্রতিদিন অন্তত ২০ মণ গাছ কাটতে হয়। কাটা গাছ পরিবহন করা হয় চান্দের গাড়িতে।

একে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছে

অন্তত ১০টি আইন ও বিধিমালা দ্বারা নির্বিচার গাছ ও পাহাড় কাটার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে। বনজ সম্পদ পরিবহন (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুসারে সরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন যেকোনো জমিতে কোনো গাছ থাকলেই তা নিজের ইচ্ছেমতো কাটা যায় না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের পাহাড়ের গাছ কাটার বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার নুর সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এটি স্পষ্টতই আইনের লঙ্ঘন। আর ক্যাম্পাসের জায়গায় পাহাড় কাটলে তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই দেখবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এস এম মনিরুল হাসান বলেন, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরের গাফিলতি রয়েছে। এই দপ্তরের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলা হয়েছে।

তবে নিরাপত্তা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মো. বজল হক দাবি করেন, পাহাড় কাটার বিষয়টি তদারক করা এস্টেট (ভূ-সম্পত্তি) শাখার কাজ। নিরাপত্তা দপ্তরের কাজ হলো বিভিন্ন অনুষদ ও অফিসের নিরাপত্তা দেওয়া।

এস্টেট শাখার সদ্য বিদায়ী প্রশাসক অধ্যাপক মো. তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু দুর্গম জায়গায় সব সময় যাওয়া যায় না। এসব দেখাশোনা করা নিরাপত্তা দপ্তরের কাজ।

হুমকির মুখে বন্য প্রাণী

নির্বিচার গাছ ও পাহাড় কাটায় ক্যাম্পাস এবং আশপাশের পরিবেশ আর বন্য প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। নষ্ট হচ্ছে তাদের আবাসস্থল। তিন বছর আগেও ক্যাম্পাসে প্রায় হরিণ দেখা যেত। এখন কদাচিৎ দেখা যায়। বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও প্রাণী আবাসস্থল হারিয়ে সমতলে ফিরে আসছে। গত ২ ডিসেম্বর ক্যাম্পাসে ১০ ফুট দৈর্ঘ্যের ডার্ক পাইথন প্রজাতির একটি অজগর পাওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. ফরিদ আহসান বলেন, ক্যাম্পাসের আশপাশের পাহাড়ি অঞ্চলে একসময় ৩৫ প্রজাতির সাপ, ১৬ প্রজাতির ব্যাঙ, আঠারো প্রজাতির টিকটিকি ও গিরগিটি, দুই শ প্রজাতির পাখিসহ অন্যান্য প্রজাতির বন্য প্রাণী ছিল। প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষায় শিগগিরই গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে।