ভেড়ার লোমের কম্বল, ঐতিহ্য টিকবে তো

ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরি করছেন আবদুল খালেক। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে।  প্রথম আলো
ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরি করছেন আবদুল খালেক। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। প্রথম আলো

ভেড়ার গা থেকে লোম কেটে সেই লোমে চরকায় সুতা কাটেন। এরপর সেই সুতা দিয়ে হস্তচালিত তাঁতে বোনেন কম্বল। ভেড়ার লোমের তৈরি কম্বল বেচেন ফেরি করে। কখনো পাঠান অভিজাত বিপণিবিতানে, যায় দেশের বাইরেও। এখন বয়স হয়েছে। আর পেরে উঠছেন না। কাজটা কাউকে শিখিয়ে রেখে যেতে চান। খুব করে চান, কেউ তাঁর কাজটা শিখে রাখুক। শিল্পটা বাঁচুক। কারণ, তাঁর জানামতে, দেশে আর কেউ ভেড়ার লোমের কম্বল তৈরি করে না।

শেষ পর্যন্ত ঢাকার খামারবাড়িতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরেও ধরনা দিয়েছেন। অনুরোধ জানিয়েছেন একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে। যেন হাতে–কলমে কাজটা শিখিয়ে যেতে পারেন। সেটা মাস ছয় আগের কথা, কিন্তু এখনো সাড়া মেলেনি। এখন আর তেমন কম্বল বুনছেন না। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া শতবর্ষী তাঁতটি প্রায়ই নিশ্চুপ থাকে। দিন কয়েক আগে আবার সচল হয়েছে। পরিচিত এক ব্যক্তি একটি কম্বলের জন্য খুব করে ধরেছেন। সেই অনুরোধ ফেলতে পারেননি আবদুল খালেক। ভেড়ার লোম দিয়ে আরেকটি কম্বল বুনে দিয়েছেন তিনি।

যেভাবে এ পেশায় আসা

আবদুল খালেকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নয়াগোলা গ্রামে। দেশভাগের সময় দাদা ফজলুর রহমান ভারতের বিহার থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন এ দেশে। দাদাও সেখানে এই কম্বল বোনার কাজই করতেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসার পর তাঁর দাদার হাত ধরে ১০–১৫টি পরিবার এ কাজে এসেছিল। ধীরে ধীরে তারা পেশা ছেড়ে দিয়েছে। খালেকের বাবা একরামুল হকও এই পেশায় ছিলেন। বাবার কাছেই খালেকের হাতেখড়ি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। কাজে ডুবে থাকায় এসএসসিটা দেওয়া হয়নি। এখন তাঁর বয়স তেষট্টির কোঠায়। দুই ছেলে, এক মেয়ের বাবা। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে দুটিও চলে গেছে অন্য পেশায়। খাটুনির কাজ, কঠিনও বেশ। তাই এ কাজে কেউ থাকতে চায় না।

ভেড়ার লোম সংগ্রহ

দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভেড়া পালে লোকে। ভেড়ার গায়ের লোম বছরে কম করে হলেও দুবার কেটে ফেলতে হয়। ভেড়া বেশি গরম সহ্য করতে পারে না। বিশেষ ধরনের কাঁচি দিয়ে এই লোম কাটতে হয়। একটু এদিক-ওদিক হলে চামড়া কেটে যায়। কেটে গেলেই সেখানে প্রদাহ হয়। ভেড়ার লোম কাটায় খালেক খুব দক্ষ। মিনিট সাতেকের মধ্যে একটি ভেড়ার লোম কেটে সাফ করে দেন। এই লোমই কম্বল তৈরির কাঁচামাল। আর এটা তিনি বিনা পয়সাতেই পেয়ে যান। শুধু তা–ই নয়, ভেড়ার লোম কাটার জন্য উল্টো পারিশ্রমিকও (প্রতিটি ভেড়ার জন্য ৫০ টাকা) নেন খালেক।

কত লোমে কত কম্বল

খালেকের বানানো কম্বল চার হাত লম্বা, আর চওড়ায় তিন হাত হয়। এই মাপের একটি কম্বল তৈরি করতে প্রাপ্তবয়স্ক ১৪টি ভেড়ার লোম লাগে। এই পরিমাণ লোম পরিষ্কার করে ধুয়ে শুকিয়ে নিলে আড়াই কেজি হয়। এরপর ধুনতে হয়। ভালো রোদ থাকলে এসব করতে দিন চারেক লাগে। এরপর চরকায় সুতা কাটতে হয়। সুতা শুকাতে লাগে এক দিন। তারপর হস্তচালিত তাঁতে চলে বোনার কাজ। বোনা শেষে কম্বল ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হয়। ভেড়ার লোম কাটা থেকে শুরু করে একটি কম্বল তৈরি অবধি সব মিলিয়ে আট-নয় দিন লাগে—জানালেন খালেক।

খালেকের বাড়িতে একদিন

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের অদূরে নয়াগোলা গ্রাম। ৮ ফেব্রুয়ারি সেই গ্রামে গিয়ে খালেকের বাড়ি চিনতে খুব একটা সমস্যা হলো না। এলাকার মানুষ তাঁর দাদার নাম পর্যন্ত মনে রেখেছে। নাম বলতেই লোকজন বাড়ি দেখিয়ে দিল। বাড়িতেই ছিলেন খালেক। ওপরে টিন, দেয়ালে ইটের গাঁথুনি, আর মেঝে মাটির। উঠানের এক কোণে রান্নাঘরের পাশে তাঁর তাঁত মেলার জায়গা। তাঁতখানি গোটানো। বললেন, ‘সরকার আইগিয়্যা (এগিয়ে) না আসলে হামি আর পারনু না। একজন চাইপ্যা–চিপ্যা (জোর করলে) ধরলে শেষ কম্বলটা বুনছি।’ এ জন্য খানিক আগেই ভেড়ার লোম কেটে এনেছেন বলে বস্তা থেকে লোম বের করে দেখালেন। চরকায় খানিক সুতাও কেটে দেখালেন।

ছড়িয়ে পড়ল দেশে–বিদেশে

শুরুর দিকে রাজশাহীর ক্ষিতীশ বাবুর কাছে কম্বল বেচতেন খালেক। ওই কম্বলের ওপর ক্ষিতীশ বাবু নিজে নকশা করতেন। এই ক্ষিতীশ বাবুই একদিন তাঁকে সঙ্গে করে ঢাকায় আড়ংয়ে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর থেকে খালেক নিজেই আড়ংয়ে কম্বল দিতেন। সেখান থেকে ঢাকার আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কম্বল সরবরাহ করতেন। ঢাকার আদাবরের ‘হ্যান্ড টাচ’–এর মালিক মোহাম্মদ আলী তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রেতা ধরে দিয়েছিলেন। কি পরিমাণ কম্বল বুনতেন—এমন প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনো জবাব দিতে পারলেন না খালেক। তবে ঢাকায় ‘অরণ্য’ নামের হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠানের স্টোর এক্সিকিউটিভ মারুফ হোসেন জানালেন, ২০–২৫ বছর ধরে আবদুল খালেকের কাছ থেকে ভেড়ার লোমের তৈরি কম্বল নিয়েছেন তাঁরা। বছরে ২০–২৫টা কম্বল নিতেন।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রাণিসম্পদ অর্থনীতিবিদ নন্দ দুলাল টীকাদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জানামতে বাংলাদেশে ভেড়ার লোম দিয়ে আর কেউ কম্বল তৈরি করে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবদুল খালেক তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি এখনো কাজটি করে যাচ্ছেন। তিনি মারা গেলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প ধরে রাখার কোনো উত্তরসূরি থাকবে না, এই চিন্তা থেকে তাঁরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই প্রকল্পের অধীনে কিছুসংখ্যক কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রকল্পটি এখনো পাস হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে প্রায় ৩৮ লাখ ভেড়া আছে। সব ভেড়ার লোম যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে বছরে আমাদের উৎপাদন প্রায় ১০০ কোটি টাকা বাড়বে।

খালেকের তৈরি কম্বল পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এসে খালেকের বাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি মুঠোফোনে কথা হয় নারায়ণ চন্দ্র চন্দের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরি তিনি দেখেছেন। জিনিসটা সুন্দর। তবে এর আরেকটু উন্নয়ন করা সম্ভব হলে এটা খুবই মানসম্মত একটা জিনিস হতে পারে। ভেড়া পালনের পাশাপাশি এলাকার মানুষের কুটিরশিল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। বিষয়টি তিনি প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটকে বলেছিলেন। তখন তারা ভেড়ার লোমের সঙ্গে পাটসহ আরও কিছু উপাদান মিশিয়ে একটা সুন্দর চাদর তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিয়েছিল। পরে তিনি মন্ত্রী না থাকায় সেটার কী হয়েছে বলতে পারছেন না।