উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে মাথাপিছু ৫১ টাকা

উচ্চ রক্তচাপ বাংলাদেশের জন্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন এর প্রকোপ বাড়ছে। তবে গবেষকেরা বলছেন, বর্তমান স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে বাড়তি সামান্য কিছু বিষয় যোগ করলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। এতে বছরে মাথাপিছু খরচ পড়বে ৫১ টাকা।

পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ২০টি গ্রামীণ এলাকার সঙ্গে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার ১০টি গ্রামে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে চার বছর ধরে প্রায়োগিক গবেষণা হয়েছে। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করে, সচেতনতা বাড়িয়ে এবং প্রয়োজনের সময় ওষুধ সেবন করিয়ে ভালো ফল পেয়েছেন গবেষকদের একটি দল। ইতিমধ্যে সরকার ওই গবেষণার ফলাফল ব্যবহার করা শুরু করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘কীভাবে কম খরচে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো যায়, তার উদাহরণ আমরা পেয়েছি এ গবেষণা থেকে। সরকার ৪০টি উপজেলায় উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেছে। সেই কাজে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের গবেষণার অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।’

গবেষণায় বাংলাদেশ অংশের নেতৃত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলিয়া নাহিদ। আলিয়া নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণাটি হয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ৩০টি গ্রামে। তিনটি ভিন্ন চরিত্রের জনগোষ্ঠী ও তিন ধরনের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে এই গবেষণা হলেও ফলাফল প্রায় অভিন্ন। তিন দেশই গবেষণা ফলাফল কাজে লাগাতে পারবে।’

তিন দেশের এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন গবেষক ও বিজ্ঞানী। দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামাঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধ ২০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন–এ ছাপা হয়েছে।

উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ, হৃদ্‌রোগের মতো অসংক্রামক রোগের প্রকোপ দেশে বাড়ছে। গত মাসে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ প্রকাশ করেছে জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)। জরিপে দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রায় অর্ধেক নারী ও  দুই–তৃতীয়াংশ পুরুষ জানেনই না যে তাঁরা এ সমস্যায় ভুগছেন।

উচ্চ রক্তচাপে থাকা ব্যক্তিদের হঠাৎ হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। দেশে অকালমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোক।

কী করেছেন গবেষকেরা

গবেষকেরা ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের গ্রামাঞ্চলে ১০টি এলাকা বেছে নিয়েছেন (পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও একই)। প্রতিটি এলাকা থেকে উচ্চ রক্তচাপ আছে, এমন ৮৫ জন করে মোট ৮৫০ জনকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পাঁচটি এলাকায় চলমান সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে কিছু বিষয় যোগ করেছেন। বাকি পাঁচটি এলাকায় শুধু নজরদারি করেছেন। ২০১৬ সালে শুরু করে গবেষণা শেষ হয়েছে ২০১৯ সালে।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা তিন মাস অন্তর গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের রক্তচাপ পরিমাপ করেন। এসব ব্যক্তির বাড়ির মানুষদের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে আলোচনা করেন, খাদ্যাভ্যাস ও শরীরের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দেন।

এরপরও যাদের রক্তচাপ উচ্চমাত্রায় দেখা গেছে, তাদের উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বলা হয়। উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ‘চিকিৎসা বিধিমালা’ (ট্রিটমেন্ট প্রোটকল) মেনে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা দিয়েছেন।

গবেষণার ফল কী

উদ্যোগ নেওয়া পাঁচটি এলাকার (ইন্টারভেনশন এরিয়া) সঙ্গে বাকি অন্য পাঁচটি এলাকার (কন্ট্রোল এরিয়া) উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতির তুলনা করেছেন গবেষকেরা। আলিয়া নাহিদ বলেন, ‘প্রথম বছর থেকেই আমরা লক্ষ করছিলাম গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত থাকা ব্যক্তিদের উচ্চ রক্তচাপ কমে আসছে এবং চতুর্থ বছরে এসে দেখা গেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রক্তচাপ গড়ে তা ৯ মাত্রায় কমে আসে।’

আলিয়া নাহিদ বলেন, গবেষণার আওতায় থাকা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের মধ্যে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু কমেছে। এ ছাড়া গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবার মানও বেড়েছে।

যেকোনো গবেষণার ফলাফল দেশব্যাপী বা বড় পরিসরে প্রয়োগ করতে হলে খরচের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আলিয়া নাহিদ বলেন, বাংলাদেশি মুদ্রায় বছরে মাথাপিছু ৫১ টাকা খরচ করলে উচ্চ রক্তচাপে থাকা মানুষের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।