মা-প্রধান হলেও মজুরি বৈষম্যে গারো নারীরা

নিজের জমিতে কৃষি কাজ করছেন গারো নারীরা।  ছবি: প্রথম আলো
নিজের জমিতে কৃষি কাজ করছেন গারো নারীরা। ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার রঞ্জিতা মৃ পেশায় দিনমজুর। ধানখেত আর কলা ও আনারসবাগানে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে তিনি মজুরি পান ২৫০ টাকা। অথচ একই কাজ করে তাঁর স্বামী পান ৩৫০ টাকা।

গায়রা গ্রামের ৩৮ বছর বয়সী গারো এই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেদের সমান কাজ করি। কখনো কখনো বেশিও করা হয়। কিন্তু মজুরি ছেলেদের থেকে ১০০ টাকা কম পাই। খারাপ লাগে।’

ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে উপজেলার কাকড়াগুনী, শোলাকুঁড়ি, জলচ্ছত্র, আমলিতলা গ্রামেও নারী-পুরুষের মজুরির বৈষম্য দেখা গেল। গ্রামভেদে এ পার্থক্য ৫০-১০০ টাকা। এমনকি গারো কর্মদাতারাও এ বৈষম্য করেন।

মাতৃবংশীয় গারোদের গোত্র-পদবি হয় মায়ের সূত্রে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার মেয়েদের। বিয়ের পর স্বামী যান স্ত্রীর বাড়িতে বসবাস করতে। প্রথামতো পরিবারের কর্তৃ হন মা অথবা নির্বাচিত ‘নকনা’, অর্থাৎ মা-বাবাকে দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি মেয়ে।

তারপরও এই পাঁচ গ্রামে অনেকগুলো পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে বোঝা গেল, সংসারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের মতামতই প্রাধান্য পায়। বড় বড় সিদ্ধান্ত সচরাচর পুরুষেরাই নেন। বাইরে কাজের পাশাপাশি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হেঁশেল মেয়েদেরই সামলাতে হয়।

রঞ্জিতার ঘরে তিনিই রান্নাবান্নার কাজ করেন। তবে স্বামী পারভেজ চিচাম তিন সন্তানকে সামলাতে সাহায্য করেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই তাঁরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

শেরপুরের পারভেজ ২০০৫ সালে বিয়ের পর গায়রার বাসিন্দা হয়েছেন। বললেন, ‘জামাই হয়ে আসা’র পর থেকে নারী-পুরুষের মজুরিতে এমন বৈষম্য দেখছেন। রঞ্জিতার মা তেনুনী মৃর বয়স হয়েছে ৭০। তিনি বহুকাল আগেও পুরুষের চেয়ে কম মজুরিতে জন খেটেছেন।

অথচ মধুপুরের গারো নারীরা সব ধরনের পেশায় অবাধে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। আবার কিছু কাজ আছে, যা কেবল নারীদের করতে হয়, হীন কাজ বলে পুরুষ শ্রমিকেরা করেন না। তবে বাগানে বা জমিতে বিষ ছিটানোর মতো ঝুঁকির কাজ করেন শুধু পুরুষেরা।

মধুপুরবাসী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর সংগঠন জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক প্রথম আলোকে বলেন, মজুরিবৈষম্য কিছুটা আছে। মেয়েরা মাটি কোপানো, ভারী বস্তা বওয়া এবং ঝুঁকির কাজ কম করেন বলে এমনটা হচ্ছে।

কাকড়াগুনী গ্রামের সরু মাটির রাস্তা দিয়ে পথ চলতে গিয়ে পাশের আনারসবাগানে চোখ যায়। সেখানে চার নারী এবং দুই পুরুষ শ্রমিক আনারসের চারার পরিচর্যা করছিলেন। শোলাকুঁড়ি গ্রামে দেখা গেল দুজন পুরুষ শ্রমিককে নিয়ে এক মা ও মেয়ে ধানের চারা রোয়ার কাজ করছেন। মেয়েটি সবার আগে কাজ শেষ করলেন।

বাংলাদেশ গারো ছাত্রসংগঠন বলছে, ২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে সারা দেশে গারো মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় দেড় লাখ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সেড) ২০১৮ সালের একটি জরিপ বলছে, মধুপুরের ১১টি ইউনিয়নে ১৭ হাজারের মতো গারো আছে। তাদের ৪৮ শতাংশ নারী।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের নির্বাহী চেয়ারপারসন রুশিদান ইসলাম রহমান দীর্ঘদিন ধরে মজুরি ও কর্মসংস্থান নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দেশজুড়েই এই চিত্র। একই কাজ করে কম মজুরির বিষয়টি স্পষ্টতই বৈষম্য। কাজের প্রয়োজন বেশি এবং দর-কষাকষির ক্ষমতা কম থাকায় গারো মেয়েরা মজুরিবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অথচ আইন অনুযায়ী সমান কাজের মজুরি সমান হবে।

শোলাকুঁড়িতে সাড়ে সাত একরের কাছাকাছি আনারসবাগান ও ১০ একরের কলাবাগান রয়েছে মো. ফরহাদ আলীর। তিনি নারী শ্রমিকের মজুরি দেন দৈনিক ৩০০ টাকা। পুরুষের মজুরি ৪০০ টাকা। ফরহাদ আলীর বক্তব্য, মেয়েরা পুরুষের চেয়ে একটু কম কাজ করেন। তাই মজুরিও কিছুটা কম।

তবে পুরুষ শ্রমিকেরা কিন্তু বলছেন, নারীরা তাঁদের থেকে কাজ কম করেন না। কিছু কৃষিকাজের ক্ষেত্রে নারীদের পারদর্শিতা বরং বেশি। গায়রা গ্রামে পারভেজ চিচাম বলেছিলেন, সমান কাজ করেও তাঁর স্ত্রী রঞ্জিতা তাঁর চেয়ে কম মজুরি পান।

এ গ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন দ্বিজনী নকরেক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মাতৃপ্রধান পরিবার হলেও সব ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য। কেবল সম্পত্তি আর কাগজে-কলমে মেয়েদের ক্ষমতা বেশি, এই যা। অথচ মেয়েরা ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ করেন।’