করোনাভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে

চীনের বাইরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ছবি: রয়টার্স
চীনের বাইরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ছবি: রয়টার্স

চীনের পর এশিয়ায় করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। ইতালি ও ইরানেও সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে মহামারির পর্যায়ে না যায়, সেদিকে সব দেশকেই প্রস্তুতির তাগিদ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

অথচ সেই দক্ষিণ কোরিয়ারই এক নাগরিককে নিয়ে রাখঢাক করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। গতকাল মঙ্গলবার সকালে জ্বর ও ডায়রিয়াজনিত সমস্যা নিয়ে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার এক নাগরিক। তিনি চিকিৎসা নেননি এবং ভর্তিও হননি। তিনি বাসায় ফিরে যান। এরপর দুপুরের দিকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।

এর আগে গতকাল দুপুর ১২টায় করোনাভাইরাস-বিষয়ক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার ওই নাগরিকের বিষয়ে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ওই বিদেশিকে বাড়িতে কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে। তাঁর শরীর থেকে নমুনা (রক্ত বা লালা বা উভয়ই) সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গতকাল বিকেলে জানা যায়, ওই কোরীয় নাগরিক কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি আছেন। একটি সূত্র জানায়, ওই কোরীয় নাগরিক ১০ দিন আগে ঢাকায় এসেছেন। জ্বর ও ডায়রিয়াজনিত সমস্যা নিয়ে তিনি সকালে হাসপাতালে আসেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যান। পরে আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা তাঁর বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। আর ওই ব্যক্তি দুপুরের দিকে হাসপাতালে ভর্তি হন।

বিকেলে মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে জানান, পরীক্ষায় ওই কোরীয় নাগরিকের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি। কিন্তু কেন তিনি প্রথমে হাসপাতালে ভর্তি হননি, সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা কারও কাছ থেকে জানা যায়নি।

>

সংক্রমণ যাতে মহামারির পর্যায়ে না যায়, সে জন্য সব দেশকেই প্রস্তুতির তাগিদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। ইরানের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী ও এক এমপি আক্রান্ত।

গতকাল সন্ধ্যায় পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইইডিসিআর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে একজনের শরীরেও কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়নি।

ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতির সব বিষয় সুষ্ঠুভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া দরকার। ছোট একটি ভুলের জন্য বড় ধরনের মাশুল যেন দিতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। তথ্যের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা না থাকলে নানা ধরনের সংশয় দেখা দিতে পারে।

গতকাল বিকেলে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও চিকিৎসাবিষয়ক পরিকল্পনা নিয়ে সভায় আলোচনা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ, আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এম এ ফয়েজ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি হাম্মান এল সাক্কা, যুক্তরাষ্ট্র সিডিসির স্থানীয় পরিচালক মাইকেল ফ্রিডম্যান উপস্থিত ছিলেন।

গতকাল বেলা আড়াইটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা কিট আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, কোভিড-১৯-এর কোনো নেতিবাচক বড় প্রভাব চলমান প্রকল্পগুলোর ওপর পড়বে না।

এদিকে সিঙ্গাপুরে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত বাংলাদেশের ৩৯ বছরের অভিবাসী শ্রমিকের পরিবারকে ১০ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলারের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে দ্য মাইগ্রেন্টস ওয়ার্কার্স সেন্টার (এমডব্লিউসি)। ৮ ফেব্রুয়ারি ওই রোগে আক্রান্ত বাংলাদেশি এখনো সেখানকার একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রয়েছেন। অসুস্থ অভিবাসী শ্রমিকের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াই-কে ইনোভেশনস, মিনি এনভায়রনমেন্ট সার্ভিসেস এবং এমডব্লিউসি ওই আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম কোভিড-১৯ রোগ সংক্রমণের কারণে সেখান অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে গত সোমবার তিনি ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় জানান, কোনো বাংলাদেশি নাগরিক এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ইরানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন দেশটির উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী ইরাজ হারিরছি এবং রাজধানী তেহরানের একটি এলাকার এমপি মাহমুদ সাদেঘি। চীনের বাইরে করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে ইরানে, ১৬ জন। দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছে ৬৫ জনের মতো। তবে চীনের বাইরে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ কোরিয়ায়, ৯৭৭ জন।

চীনের বাইরে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত পরশু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেডরোস অ্যাডানোম গেব্রিয়েসাস বলেছেন, হঠাৎ নতুন রোগী বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই অতি উদ্বেগের। তিনি বলেছেন, এই মুহূর্তে তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রথমত, সব দেশকে নিজের স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বয়স্ক ও অন্য রোগে ভুগছেন, এমন ব্যক্তিদের এই মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষার জন্য কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, মহামারি আটকে রেখে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। ভীতি সবার মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে, সবাই মিলে এর মোকাবিলা করতে হবে।