ধর্ষণ শেষে হত্যা, না আত্মহত্যা

মাদ্রাসার ছাত্রীনিবাসের গোসলখানায় ছিল মেয়েটি। তাকে কাপড় দিয়ে আসে অপর এক ছাত্রী। ১০-১৫ মিনিট পর গোসলখানায় গিয়ে তাকে আর পাওয়া যায়নি। খুঁজতে খুঁজতে একই ভবনের চতুর্থ তলায় যায় ওই ছাত্রী। সেখানে মেলে মেয়েটির ঝুলন্ত লাশ। পরনে পাজামা ছাড়া কোনো কাপড় ছিল না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক মাদ্রাসায় গত সোমবার এ ঘটনা ঘটেছে। পরিবার ও পুলিশ বলছে, মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হতে পারে। তবে জড়িত ব্যক্তিরাই তাকে হত্যা করেছে, নাকি ধর্ষণের শিকার হয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করে, তা পরিস্কার নয়। মামলায় মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকসহ ছয়জনকে আসামি করেছে মেয়েটির পরিবার। পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা হলেন মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা (৪২), সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেন (৩৫), মো. ইউনুছ ও মো. আলামিন।

ওই ছাত্রীর নাম আমেনা আক্তার (১১)। সে নবীনগর উপজেলার সলিমগঞ্জ জান্নাতুল ফেরদাউস মহিলা মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। বাড়ি পাশের বাঞ্ছারামপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে। 

পরিবার, পুলিশ ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, আমেনা আক্তার তিন বছর আগে সলিমগঞ্জ জান্নাতুল ফেরদাউস মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। তখন থেকেই ছাত্রীনিবাসে থাকছিল। একই ভবনে মাদ্রাসার পাঠদান, ছাত্রীনিবাস ও অফিস কক্ষ।

সোমবার আসরের নামাজের পর আমেনা ছাত্রীনিবাসের গোসলখানায় গিয়েছিল। মাদ্রাসার অপর এক ছাত্রী সেখানে গিয়ে তাকে কাপড় দিয়ে আসে। ১০-১৫ মিনিট পর ওই ছাত্রী আবার গোসলখানায় যায়। কিন্তু আমেনাকে পায়নি। এরপর তাকে খুঁজতে থাকে। এভাবে ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে যায়। পরে মাদ্রাসার চতুর্থ তলায় যায়। সেখানে চিলেকোঠায় জানালার রডের সঙ্গে আমেনার ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়। তার পরনে পাজামা ছাড়া কোনো কাপড় ছিল না। চিৎকার দেয় ওই ছাত্রী। তখন অন্যান্য ছাত্রীরা ঘটনাস্থলে যায়। পরে প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফাসহ অন্যরা উপস্থিত হন।

পুলিশ রাত ১০টার দিকে লাশটি উদ্ধার করে। রাতেই মাদ্রাসা থেকে প্রধান শিক্ষক মোস্তফা ও সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেনকে আটক করে। পরে সলিমগঞ্জ গ্রাম থেকে সহকারী শিক্ষক ইউনুছ ও আলামিনকে আটক করে তারা। গতকাল মঙ্গলবার ময়নাতদন্তের পর লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ।

আমেনার মা সেলিনা খাতুন গতকাল অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার মেয়েকে প্রধান শিক্ষক তাঁর কক্ষে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেছেন। পরে বিষয়টি আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।’

পরিবারের অভিযোগ ও পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনা মেলানোর পর পুলিশও বলছে, মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হতে পারে। ঘটনার পর মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। ধর্ষণে জড়িত ব্যক্তিরাও তাকে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখতে পারে। ছাত্রীনিবাসের মেয়েদের দেখাশোনা করেন ফারজানা বেগম নামের এক নারী শিক্ষক ও একজন নারী বাবুর্চি। গত শনিবার থেকে ফারজানা ছুটিতে আছেন। ফলে মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্ব পান নারী শিক্ষক খাদিজা। প্রধান শিক্ষক মোস্তফা ঘটনার দুই ঘণ্টা আগে খাদিজা ও ওই বাবুর্চিকে ছুটি দিয়ে দেন।

নবীনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাগুলো সন্দেহ জাগায়। তা ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে প্রধান শিক্ষক মোস্তফা বিভিন্ন কথা বলেছেন। যাচাই-বাছাইয়ে সেসব তথ্যে গরমিল পাওয়া গেছে। মোস্তফা দাবি করেছেন, তিনি এলাকার এক যুবকের সঙ্গে সোমবার দুপুর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ছিলেন। কিন্তু ওই যুবক বলেছেন, মোস্তফার সঙ্গে আসরের নামাজের পর তাঁর দেখা হয়েছিল মাত্র।

মামলার এজাহারেও এসব কথা আছে। আসামি হয়েছেন প্রধান শিক্ষক মোস্তফার পাশাপাশি মাদ্রাসার পরিচালক আবদুল মান্নান। অপর চার আসামিও মাদ্রাসার শিক্ষক। এজাহারে বাদী সেলিনা অভিযোগ করেছেন, প্রধান শিক্ষক মোস্তফা ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালাতে অন্য আসামিদের সহযোগিতায় লাশের গলায় ফাঁস লাগিয়ে রাখেন।

আসামিদের গতকাল আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে নবীনগর থানার ওসি রণজিৎ রায় প্রথম আলোকে বলেন, এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের পর হত্যা ও এতে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে।