৩৮ বছর পর ফিরে এলেন তিনি, তবে...

নিরুদ্দেশ হওয়ার ৩৮ বছর বাড়ি ফেরেন নওগাঁর সাপাহার উপজেলার দক্ষিণ আলাদীপুর গ্রামের নুরুজ্জামান। ছবি: প্রথম আলো
নিরুদ্দেশ হওয়ার ৩৮ বছর বাড়ি ফেরেন নওগাঁর সাপাহার উপজেলার দক্ষিণ আলাদীপুর গ্রামের নুরুজ্জামান। ছবি: প্রথম আলো

পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে স্ত্রী-সন্তানকে রেখে ৩৮ বছর আগে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন নওগাঁর সাপাহার উপজেলার দক্ষিণ আলাদীপুর গ্রামের নুরুজ্জামান। বর্তমানে ৬০ বছর বয়সী নুরুজ্জামান গত সোমবার হঠাৎ করেই নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরায় স্বজনেরা আনন্দিত। তবে ফতোয়ার কারণে তিনি তাঁর স্ত্রী আরিফন বিবির (৫২) সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ।

পরিবার ও গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়, ১৯৮২ সালে দুই নাবালক ছেলে ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে উপজেলার দক্ষিণ আলাদীপুর গ্রামের বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন নুরুজ্জামান। অনেক বছর খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। স্বজনেরা ধরে নিয়েছিলেন, তিনি মারা গেছেন অথবা কেউ তাঁকে মেরে ফেলেছেন। দীর্ঘদিন প্রতীক্ষার পর তিন ছেলেকে নিয়ে উপজেলার কৃষ্ণসদা গ্রামে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন আরিফন।

গত সোমবার দুপুরে দক্ষিণ আলাদীপুর গ্রামে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন নুরুজ্জামান। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরায় স্বজন ও গ্রামবাসীর মধ্যে হইচই পড়ে যায়। এই খবর পেয়ে নুরুজ্জামানের স্ত্রী আরিফন বিবি তিন ছেলেকে নিয়ে নুরুজ্জামানের বাড়িতে আসেন। তিন ছেলের সঙ্গে বাবার দেখা হয়। তবে গ্রাম্য মাতবরদের ফতোয়ার কারণে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি আরিফন।

আরিফন বিবি বলেন, ‘অ্যাত দিন ধরে এক বুক আশা নিয়ে স্বামীর পথ চ্যায়া ছিনু। অ্যাখন স্বামী ফিরে অ্যালো কিন্তু তাঁর সাথে দেখা করতে পারছি না। গ্রামের মাতব্বররা বলোছে। হামাগের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আগেই য্যামন ছিনু, অ্যাখনো ত্যামনিই থাকা লাগব।’

নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ সম্পর্কে নুরুজ্জামান বলেন, তিনি বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দক্ষিণ আলাদীপুর গ্রামে থাকতেন। পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে বাবা আবদুর রাজ্জাকের ওপর অভিমান করে ১৯৮২ সালে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান তিনি। বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার পর দীর্ঘদিন রংপুর শহরে দিনমজুরের কাজ করে জীবনযাপন করেছেন। আর কখনো বাড়ি ফিরবেন না—এমন প্রতিজ্ঞা করে ১৯৮৫ সালে রংপুরে দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার পাতেন তিনি। ওই সংসারে তাঁর তিন ছেলে আছে।

নুরুজ্জামান বলেন, ‘আমি খুব জেদি ছিলাম। সামান্য কারণে বাবার ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলাম। কিন্তু এত দিন পর আমি বুঝতে পেরেছি আমার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি আমি অন্যায় করেছি। তাঁদের হক নষ্ট করেছি। এ জন্য দীর্ঘদিন পরে হলেও স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছি। ফিরে এসে ছেলেদের দেখতে পেলেও স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। গ্রামের মাতব্বররা বলছেন, আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার নাকি বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।’

নুরুজ্জামানের ছেলে আনারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বয়স যখন দুই বছর, তখন বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। তাই বাবার কোনো স্মৃতি আমার মনে ছিল না। ছোটবেলা থেকে বাবার গল্প মা-নানির কাছ থেকে শুনে আসছি। কিন্তু কোনো দিন ফিরে পাব, এমন আশা করিনি। এত দিন পর সেটা পূরণ হয়েছে। ভালো লাগছে। তবে বাবা-মা একসঙ্গে হতে পারছেন না, দেখা করতে পারছেন না; বিষয়টা খুব কষ্ট দিচ্ছে।’

এ বিষয়ে গোয়ালা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান মুকুল বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা শুনেছি। সমস্যাটি নিরসনে তাদের পরিষদে ডেকে এলাকার সুধীজনদের পরামর্শ নেওয়া হবে। সে অনুযায়ী সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’