সড়ক আইন কাগজে, বিশৃঙ্খলা সড়কে

>
  • শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কঠোর আইন হলেও তা এখনো কাগজেই রয়ে গেছে
  • সড়কে প্রাণহানি ও দুর্ঘটনা-দুটিই বেড়েছে

নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। কঠোর শাস্তির ভয়ে চালকেরা লাইসেন্স সংগ্রহ করবেন—এমনটা ভাবা হলেও বাস্তবে এর উল্টোটা হয়েছে। নতুন লাইসেন্স সংগ্রহ ও পুরোনো লাইসেন্স নবায়নের আবেদন কমে গেছে। বেড়েছে ফিটনেসবিহীন যানবাহনও। আইন অমান্যের দায়ে জরিমানা আদায় ও সাজার পরিমাণ বেশ কমেছে।

সংসদে পাস হওয়ার এক বছরের বেশি সময় পর গত ১ নভেম্বর নতুন সড়ক আইন কার্যকর হয়। এর আগে–পরের সময়ের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সরকার কঠোর আইনটি করলেও এর সুফল বা ইতিবাচক কোনো প্রভাব পরিবহন খাতে এখনো পড়েনি। অর্থাৎ আইন এখনো কাগজেই রয়ে গেছে।

গত নভেম্বরে মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স–সংক্রান্ত কিছু ধারা আগামী জুন পর্যন্ত প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এই সময়ের মধ্যে যানবাহন ও চালকের প্রয়োজনীয় বৈধ কাগজপত্র হালনাগাদ করার পরামর্শ দিয়েছিল সরকার। এর জন্য জরিমানা মওকুফ, প্রক্রিয়া সহজতর করাসহ মালিক-শ্রমিকদের নানা সুবিধা দেওয়া হয়।

পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের দেওয়া ওই বিশেষ সুবিধা আগামী চার মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। অথচ এখন পর্যন্ত আইনের বিধিমালা করেনি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। আইন প্রয়োগে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতিও পুরো সম্পন্ন হয়নি।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। সড়ক আইন প্রয়োগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, আগামী জুনের পর পুরোদমে আইনের প্রয়োগ শুরু হবে। মালিক-শ্রমিকদের জুন পর্যন্ত সময় দেওয়ার কারণে মামলা-জরিমানা কমেছে। জুনের মধ্যে তারা প্রয়োজনীয় কাগজ হালনাগাদ না করলে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে। সেটা নিশ্চয়ই মালিক-শ্রমিকদের বিবেচনায় আছে। লাইসেন্সের কম আবেদনের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, বিআরটিএ লাইসেন্স কার্ড দিতে পারছে না। এটাও একটা কারণ হতে পারে।

এত সুযোগের পরও ফিটনেসে গাফিলতি
নতুন সড়ক আইনে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চালালে সর্বোচ্চ×ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ট্যাক্স-টোকেনের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ হাজার টাকা।

আইনটি কার্যকরের পর পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মুখে গত ২০ ও ২৩ নভেম্বর তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দুই বৈঠকে ফিটনেস, ট্যাক্স–টোকেন ও রুট পারমিট হালনাগাদ করার জন্য সময় চান মালিক-শ্রমিকেরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের জুন পর্যন্ত সময় দেন। এমনকি গত ২০ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ফিটনেস, ট্যাক্স-টোকেন, রুট পারমিট ও লাইসেন্স নবায়নে জরিমানাও মওকুফ করে দেয়।

কিন্তু বিগত প্রায় চার মাসে ফিটনেসবিহীন যানবাহন আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, সড়ক আইন কার্যকরের আগে গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ছিল ৪ লাখ ৩ হাজার ৫৩৩টি। ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪৩২টি। অর্থাৎ ফিটনেসবিহীন যানবাহন বেড়েছে ৩৯ হাজার ৮৯৯টি।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আকৃতি পরিবর্তন করার কারণে কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাকের বেশির ভাগই ফিটনেস সনদ পাওয়ার যোগ্য নয়। সড়কে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কঠোর না হলে বাণিজ্যিক যানের মালিকেরা পাত্তা দিতে চান না। নতুন আইন প্রয়োগে সরকারের শিথিল অবস্থান তাঁদের আরও সাহসী করে তুলেছে।

পরিবহনমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, যানবাহনের ফিটনেসের ক্ষেত্রে মালিকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁরা নিয়মিত বৈঠক করে চাপ দিচ্ছেন। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে যানবাহনের সৌন্দর্যবর্ধনে জোর দিয়েছেন তাঁরা। ফলে ফিটনেসবিহীন যানবাহন থাকবে না।

লাইসেন্স কম, আগ্রহও নেই
বিআরটিএর হিসাবে, দেশে যানবাহন আছে সাড়ে ৪৩ লাখ। আর চালক আছেন ২৮ লাখের মতো। প্রায় ১৫ লাখ যানবাহনের চালক নেই। হালকা যানের চালক বাস ও ট্রাক চালাচ্ছেন। কারও কারও আবার কোনো লাইসেন্সই নেই। নতুন সড়ক আইনে এই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। ফলে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর অন্যতম দাবি ছিল লাইসেন্সের জন্য যাতে মামলা না দেওয়া হয়।

মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে লাইসেন্স–সংক্রান্ত ধারার শাস্তি জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, চালকদের জুনের মধ্যে লাইসেন্স হালনাগাদ করে নিতে হবে। কিন্তু এতেও সাড়া না পেয়ে ২ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া শিথিল করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এর ফলে এক বছরের অভিজ্ঞ চালকেরা হালকা থেকে মাঝারি এবং মাঝারি থেকে ভারী যানের লাইসেন্স পাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। অথচ আইনে মাঝারি যানের লাইসেন্স পেতে তিন বছর এবং ভারী যানের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে।

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে নতুন লাইসেন্সের আবেদন পড়েছিল ৩৭ হাজারের বেশি। ওই মাসে নবায়ন ও লাইসেন্সের শ্রেণি (হালকা, মাঝারি ও ভারী) পরিবর্তনের আবেদন পড়ে ৯ হাজারের মতো। গত জানুয়ারি মাসে নতুন আবেদন কমে দাঁড়ায় সোয়া ২১ হাজার। এই মাসে লাইসেন্স নবায়ন ও শ্রেণি পরিবর্তনের সংখ্যাও কমে হয় সোয়া ৭ হাজার।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, স্মার্ট কার্ডের অভাবের কারণে বিআরটিএ গত এক বছর লাইসেন্স কার্ড দিতে পারছে না। নতুন সরবরাহকারী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এ জন্য লাইসেন্সের আবেদন কিছুটা কমে যেতে পারে। তবে লাইসেন্স দেওয়ার কার্যক্রম বন্ধ নেই। লাইসেন্স পরীক্ষায় কৃতকার্যদের সনদ দেওয়া হচ্ছে।

আইনের প্রয়োগ কমছে
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ গত অক্টোবরে সারা দেশে পরিবহনসংক্রান্ত মামলা করে ৩ লাখ ৫২ হাজার। জরিমানা আদায় করে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। সড়ক আইন কার্যকর হওয়ার পর নভেম্বরে মামলা হয় ৬০ হাজারের মতো। জরিমানা আদায় হয় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে মামলা আরও কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩৫ হাজার। জরিমানা আদায় হয় মাত্র ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে আইন প্রয়োগে শিথিল হওয়ার নির্দেশনা আছে। মামলা দেওয়ার যন্ত্রের সফটওয়্যারও হালনাগাদ হয়নি। আইন সংশোধনের তৎপরতা এবং কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে সফটওয়্যার হালনাগাদে দেরি হচ্ছে।

সড়কের মাঝখানে বাস থেকে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছেন চালক। গতকাল সকালে রাজধানীর কলেজ গেট–সংলগ্ন এলাকায়।‍  সাবিনা ইয়াসমিন
সড়কের মাঝখানে বাস থেকে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছেন চালক। গতকাল সকালে রাজধানীর কলেজ গেট–সংলগ্ন এলাকায়।‍ সাবিনা ইয়াসমিন

অন্যদিকে ২০০৯ সাল থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে বিআরটিএ। তাদের মূল কার্যক্রম ঢাকায়। শুরুতে ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা কম থাকলেও তা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয়। বিআরটিএর তথ্য বলছে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কারণে ২০১৮ সালে সর্বাধিক প্রায় ৪০ হাজার মামলা হয়। জরিমানা আদায় করা হয় ৬ কোটি ৭২ লাখ টাকার বেশি। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৫৬ লাখ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। মাসে গড়ে ৬০ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অথচ গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে জরিমানা আদায় হয় মাত্র ১৬ লাখ ৩৪ হাজার ৪০০ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জরিমানা আদায় করা হয় সোয়া ১৯ লাখ। আর গত বছরের জানুয়ারিতে সাড়ে ৫৪ লাখ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছিল।

অস্পষ্টতা, প্রস্তুতির ঘাটতি
নতুন সড়ক আইনের ৮-১০টি ধারা পরিবর্তন চায় পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। এর মধ্যে অন্যতম হলো তিনটি অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা। এ ছাড়া চালকের লাইসেন্স–সংক্রান্ত অপরাধ, যানবাহনের আকৃতি পরিবর্তন ও ফিটনেস–সংক্রান্ত অপরাধের সাজা কমানোর লিখিত দাবিও দিয়েছে তারা। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তাসচিবকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি দুটি বৈঠক করেছে। তবে কোন কোন ধারা পরিবর্তন করতে হবে, এই বিষয়ে কোনো সুপারিশ চূড়ান্ত হয়নি।

নতুন সড়ক আইনের পাঁচটি ধারার অপরাধের জন্য চালকের পয়েন্ট কাটার বিধান রয়েছে। কিন্তু কীভাবে তা করা হবে এবং এর তথ্য কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেটরা অন্ধকারে।

সড়কে প্রাণহানি ও দুর্ঘটনা—দুটিই বেড়েছে
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস হয়। প্রত্যাশা ছিল কঠোর শাস্তির মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে, কমবে প্রাণহানি ও দুর্ঘটনা। কিন্তু গত বছর সড়কে প্রাণহানি ও দুর্ঘটনা—দুটিই বেড়েছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর হিসাব বলছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৫ হাজার ২২৭ জন। ২০১৮ সালে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৪৩৯। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সড়কে প্রাণহানি বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ। এই এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়েছে, ১ হাজার ৫৫৯টি।

জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে সরকারে পূর্ণ মনোযোগ না থাকলে এ থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সরকারের মধ্যে সেই মনোযোগ দেখা যাচ্ছে না। আইন প্রয়োগের প্রস্তুতি ও অবকাঠামোর ব্যাপক অভাব আছে। পরিবহনমালিক–শ্রমিকেরা অতীতে দেখেছেন, সরকার কখনো কঠোর, কখনো নরম আচরণ করে। ফলে সরকার কঠোর হলে তাঁরা আন্দোলনে নামেন। নরম হলে বিশৃঙ্খলায় ফিরে যান। এই চক্রেই চলছে পরিবহন খাত।

অধ্যাপক সামছুল হক আরও বলেন, পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা নিয়ে সমাজের সব স্তরেই উদ্বেগ আছে। এ জন্য নতুন সড়ক আইন, কঠোর শাস্তির বিধান মানুষের মধ্যে আশা তৈরি করেছিল। ভীতিও কিছুটা এসেছিল। কিন্তু মালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে ছাড় দেওয়ার ফলে মোমেন্টাম বা গতিটা কমে গেছে। এ জন্য সরকারের শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান দরকার ছিল।