'হাত থেকে রুশদী ছুটে গেল...বাঁচাতে পারলাম না'

মায়ের কোলে শিশু এ কে এম রুশদী। ফাইল ছবি
মায়ের কোলে শিশু এ কে এম রুশদী। ফাইল ছবি

বৃহস্পতিবার গভীর রাত। ঘড়ির সময় আনুমানিক রাত সাড়ে তিনটা। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে রাজধানীর ইস্কাটনের ৪৫/এ দিলু রোডের বাড়িটিতে। পাঁচতলার ভবন এটি। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণ বাঁচাতে ভবনের তৃতীয় তলার বাসিন্দা শহিদুল কিরমানি নিচে নেমে আসছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। আর শহিদুলের কোলে ছিল এই দম্পতির পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে এ কে এম রুশদী। কিন্তু ফ্ল্যাট থেকে বের হতে গিয়ে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হন তাঁরা।

এতে শহিদুলের হাত থেকে পড়ে যায় রুশদী। তখন আর কোনো কিছু দেখতে পাননি শহিদুল। গড়িয়ে গড়িয়ে ওই ভবনের কোনো একটি ফ্ল্যাটের বাথরুমে আশ্রয় নেন তিনি। স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসও কোথায় গেছেন তাও তাঁর অজানা। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় শহিদুলকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সকালের দিকে সেখানে জ্ঞান ফেরে তাঁর। জ্ঞান ফেরার পরই ছেলে রুশদীর খোঁজ করতে থাকেন শহিদুল। তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার হাত থেকে রুশদী ছুটে গেল, ওকে বাঁচাতে পারলাম না।’

সকালে শহিদুল কিরমানিকে দেখতে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে গিয়ে ছিলেন তাঁর সহপাঠী ফাতেমা জেরিন। তখন তিনি শহিদুলের কাছ থেকে শুনতে পান ছেলে হারানোর সেই আর্তনাদ।

ফাতেমা জেরিন প্রথম আলোকে বলেন, শহিদুল কিরমানি সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তিনি। তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনিও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। তবে আজকের ভয়াবহ আগুনে শহিদুল কিরমানি ও তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের জীবন সংকটাপন্ন। শহিদুলের শরীরের ৪৩ শতাংশ ও জান্নাতুলের শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। শহিদুলের শ্বাসনালি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।

শহিদুল ও জান্নাতুল দম্পতির ছেলে রুশদী ছাড়াও দিলু রোডের ওই বাড়িতে আরও দুজনের লাশ পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন আবদুল কাদের (৪৫) ও আফরিন জান্নাত (১৭)।

চিকিৎসক ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে আবদুল কাদের ছাড়া বাকি দুজনের শরীর একেবারে পুড়ে গেছে। তাঁদের একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। দুই পরিবারের কাছে লাশ দুটি হস্তান্তর করা হয়েছে। অবশ্য এই দুটি লাশের ডিএনএ সংরক্ষণ করা হবে।

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া আবদুল কাদেরের বাবার নাম মোহাম্মদ উল্লাহ। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম নন্দনপুর গ্রামে তাঁদের বাড়ি। তিনি ওই ভবনের নিচতলায় অবস্থিত ‘ক্ল্যাসিক ফ্যাশন’ বায়িং হাউসের অফিস সহকারী ছিলেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। স্ত্রী নাম মরিয়ম বেগম। তাঁরা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। কাদের তাঁর কর্মস্থলেই থাকতেন। আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে তাঁর স্বজনেরা এসে লাশ শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় প্রাণ হারানো আফরিন জান্নাত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৪২) পূর্ত ভবনের প্রশাসনিক সেকশনে চাকরি করেন। আফরিনের মা লাল বানু (৩৫) গৃহিণী। তাঁরা ওই ভবনের ছাদের পাশে টিনশেডের একটি কক্ষে থাকেন।

আফরিনের চাচা মো. সুরুজ্জামান বলেন, আগুনের কারণে আতঙ্কিত হয়ে আফরিন সিঁড়ি দিয়ে নিচের নামার চেষ্টার করেন। অন্যদিকে দিকে তাঁর বাবা ও ভাই গ্রিল বেয়ে নিচে নামেন। তবে তাঁরা দুজনেই সামান্য আহত হয়েছেন। আফরিনের মা লাল বানু নিচে নামতে গিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন। তাঁর পা ও কোমরের হাড় ভেঙে গেছে। তিনি বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আফরিনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের ধারণা, এই ঘটনায় দগ্ধ হওয়া কিশোরী তাঁদেরই মেয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা ছাদ থেকে পাশের ভবনে লাফিয়ে পড়ি। আমাদের আগেই মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে চলে যায়। এটা আমারই মেয়ে।’

হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খন্দকার সেলিম শাহরিয়ার জীবন স্টালিন বলেন, মৃত তিনজনের মধ্যে শিশুসহ দুজন পুরোপুরি পুড়ে গেছে। যা দেখে শনাক্ত করার মতো না। তাই পোড়া দুজনেরই ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে ফরেনসিক বিভাগকে বলা হয়েছে। আর আবদুল কাদের পোড়েননি। সম্ভবত তিনি ধোঁয়ার কারণে মারা গেছেন।’

এসআই শাহরিয়ার বলেন, ‘পুড়ে যাওয়া লাশের দাবিদার যাঁরা, তাঁদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা করা হচ্ছে। একাধিক দাবিদার নেই। এ কারণে তাঁদের কাছেই দেওয়া হচ্ছে।’

এ দিকে আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই ভবনের বাসিন্দা সুমাইয়া আক্তার (৩০), মাহাদি (৯), মাহমুদুল হাসান (৯ মাস) ও মনির হোসেন। তাঁরা ওই ভবনের পঞ্চম তলার বাসিন্দা এবং একই পরিবারের সদস্য। তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিস অগ্নিকাণ্ডের কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি। এ নিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে তারা। ফায়ার সার্ভিস সকাল পৌনে ছয়টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে দগ্ধ ব্যক্তিদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করে।

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এহসার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোর চারটার দিকে ৪৫/এ নম্বর দিলু রোডের বাসাটিতে আগুন লাগার খবর পান তাঁরা। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট কাজ শুরু করে। প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার পর ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ভবনের গ্যারেজ থেকে আগুন ছড়িয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।’

ওই ভবনের দারোয়ান লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসার নিচে গ্যারেজ থেকে আগুন লাগে। সেখানে পাঁচটা গাড়ি ও দুটি মোটরসাইকেল রাখা ছিল। আগুন গাড়ি ও মোটরসাইকেলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর ও এলাকাবাসীর ধারণা শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডের পর ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠে যায়। ভবনের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন।’