পাপিয়ার কেএমসি বাহিনী নরসিংদী দাপিয়ে বেড়াত

ট্যাটু হাতে শামীমা নূর পাপিয়া। ছবি: সংগৃহীত
ট্যাটু হাতে শামীমা নূর পাপিয়া। ছবি: সংগৃহীত

একদল যুবক-যুবতীর হাতে ইংরেজিতে লেখা ট্যাটু —কেএমসি। যাঁদের হাতে এই ট্যাটু, তাঁদের দাবি, খাজা বাবার ভক্ত হিসেবে তাঁরা হাতে এই উল্কি এঁকেছেন। কেএমসির বিস্তারিত রূপ—খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি।

নরসিংদীতে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের কাছে এই ট্যাটু খুবই চেনা। উল্কি আঁকা যুবকেরা মাঝেমধ্যে মোটরসাইকেলে করে শহর দাপিয়ে বেড়ান। মাদক পরিবহন, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, কাউকে ধরে এনে মারধর করা, জমি দখলে অংশ নেওয়া তাঁদের কাজ। লোকে তাঁদের চেনে ‘কেএমসি বাহিনী’ নামে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই কেএমসি বাহিনী গড়ে তোলেন র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া এবং তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে মতি সুমন।

নরসিংদী আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মী প্রথম আলোকে বলেছেন, কেএমসি বাহিনীর সদস্য ৩০ থেকে ৩৫ জন। তাঁরা সবাই পাপিয়ার বেতনভুক্ত। পাপিয়া-সুমন শহরে এলে তাঁরা গাড়ির সামনে–পেছনে মোটরবাইক নিয়ে মহড়া দেন। শহরের ভাগদী ও ব্রাহ্মণদী এলাকার যুবকেরা মূলত কেএমসি বাহিনীর সদস্য। পাপিয়া গ্রেপ্তারের পর সবাই গা ঢাকা দেন। এখন কাউকে আর এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।

২২ ফেব্রুয়ারি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া, তাঁর স্বামী সুমনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তিনটি মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, পাপিয়া ও সুমনের হাতেও বাহিনী প্রতীকের উল্কি আছে। এ ছাড়া পাপিয়ার ডান বাহুতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনার ছবি ও বাঁ বাহুতে এক দেবীর ছবির উল্কি রয়েছে।

র‍্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, পাপিয়ার কর্মকাণ্ড ও জীবনযাপন খুবই রহস্যময়। যেমন নিজের বাসা ছেড়ে তিনি দিনের পর দিন পাঁচ তারকা হোটেলে থাকতেন। সিনেমার নায়িকাদের মতো সাজগোজ করে গানের দৃশ্য ভিডিও করতেন, সুইমিংপুলে মেয়েদের নিয়ে নাচানাচি করতেন, অস্বাভাবিক সাজতেন এবং সঙ্গের মেয়েদের সেভাবে সাজতে বাধ্য করতেন। ফেসবুকে তাঁর সমর্থকের সংখ্যা ৩৫ হাজারের মতো।

>

এক নেত্রীর উত্থান
মাদক পরিবহন, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, ধরে এনে মারধর করা, জমি দখল ছিল ওই বাহিনীর কাজ

র‍্যাব জানায়, পাপিয়ার আয় বলতে ছিল মাদক ব্যবসা, দালালি আর চাঁদাবাজি। বিভিন্ন লোককে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন। পুলিশ ও রেলওয়ের বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে তিনি টাকা আদায় করেছেন, এমন তথ্যপ্রমাণ র‌্যাবের হাতে আছে। জমি কেনাবেচা, ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়া, সিএনজি স্টেশনের অনুমোদন পাইয়ে দেওয়া, শিল্পকারখানায় গ্যাস–সংযোগ করে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজের লাইসেন্স ও অনুমোদন এনে দেওয়ার মধ্যস্থতা করতেন তিনি। আর এসব কাজ পাওয়ার টোপ হিসেবে পাঁচ তারকা হোটেলে আমোদ–ফুর্তির সুযোগ করে দিতেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, পাপিয়ার কাছে যাঁদের আসা–যাওয়া ছিল, তাঁদের বেশির ভাগই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। কিছু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তাঁরাই পাপিয়াকে বিভিন্ন কাজ ও সুবিধা পাইয়ে দিতেন।

ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পাপিয়ার বেপরোয়া জীবনযাপন এবং তাঁর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর নরসিংদীর স্থানীয় এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতারা যেমন জানতেন, তেমনি বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও অজানা ছিল না বলেই মনে করে সাধারণ মানুষ। কিন্তু আর্থিক লেনদেন, ভাগ–বাঁটোয়ারার বিষয় জড়িত থাকায় সবাই জেনেও চুপ ছিলেন। এখনো এই ঘটনার দায় নিতে চাচ্ছেন না কেউ।

গতকাল শুক্রবার সাভারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, পাপিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর সব পাঁচ তারকা হোটেল সরাসরি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের বিশেষ শাখার সঙ্গে যুক্ত। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেত্রী এভাবে পাঁচ তারকা হোটেলে দিনের পর অবস্থান করলেও বিষয়টি কেন তাদের নজরে এল না, সেটাই প্রশ্ন। অনেকে বলছেন, হোটেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন তাঁর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন।

জানতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা শুধু বিদেশিদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করেন। তবে অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের কাছে সবার তথ্যই আসে।

যে পাঁচ তারকা হোটেলে পাপিয়া থাকতেন, সেখানকার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে পাপিয়া নিজের নামে পাঁচটি সাধারণ কক্ষ ভাড়া নেন। এর একটি কক্ষ তিনি ও তাঁর স্বামী, বাকি চারটি কক্ষে পাঁচ তরুণীকে রাখেন। পরে তিনি একটি স্যুট ও তিনটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। হোটেল ভাড়া বাবদ এক বছরে তিনি ২ কোটি ৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেন বলে র‌্যাব জানিয়েছে।

পাঁচ তারকা হোটেলটির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, সব টাকা তিনি নগদে পরিশোধ করেন। বিল দিতে কোনো ধরনের কার্ড ব্যবহার করেননি। মজার ব্যাপার হলো, সারা দিন হোটেলে থাকলেও প্রায় রাতে তাঁদের রুম ফাঁকা থাকত। আবার সকালে এসে তাঁরা হোটেলে উঠতেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, এত দিন এসব কক্ষে কারা আসা–যাওয়া করেছে, তার খোঁজ নিতে র‍্যাব সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে গেছে। তবে ফুটেজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে না বলে তাঁরা জানান।

যেসব তরুণী পাপিয়ার সঙ্গে থাকতেন, তাঁদের তিনজনের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে র‍্যাব। বাকি দুজন পালিয়ে গেছেন। এই তরুণীদের মধ্যে চারজনের বাড়ি নরসিংদী পৌর এলাকার ভাগদীতে। মূলত চাকরি দেওয়ার নাম করে তাঁদের আনা হয়। পরে তাঁদের অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হতো। স্থানীয় কয়েকজন জানান, পাপিয়ার সঙ্গে থাকা তরুণীদের দুজনের আগে বিয়ে হয়েছিল, ভয় দেখিয়ে একজনের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটানো হয়। র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া শেখ তায়্যিবা পাপিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী। সাব্বির খন্দকার হলেন সুমনের ব্যক্তিগত কর্মচারী।

পাপিয়ার ঢাকার ইন্দিরা রোডে একটি ভাড়া বাসা আছে। তবে এখানে তাঁরা খুব কমই থাকতেন। বাসাটি সব সময় তালা দেওয়া থাকত। গতকাল বিকেলে সেখানে গেলে বাসার ব্যবস্থাপক দীপ স্বর্ণকার বলেন, পাপিয়ার পরিবার মাঝেমধ্যে বাসায় এসে থাকেন। তাঁর দুই বাচ্চা নরসিংদীতে বোনের কাছে থাকে। বাসায় কোনো গৃহকর্মী নেই। এখানে কোনো অতিথিও আসতেন না।

নরসিংদীতে পাপিয়ার দৃশ্যমান সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে পৌর শহরের ভাগদী মার্কেজ এলাকার একটি তিনতলা ভবন, একটি একতলা বাড়ি, যেখানে লোকজনকে ধরে এনে মারধর করা হতো। আরও আছে ভাগদীর বাতেন ভূঁইয়ার মিলের পাশে একটি পাঁচতলা ভবন, ব্রাহ্মণদীতে একটি ছয়তলা ভবন। এ ছাড়া ভাগদী এলাকার ২ নম্বর ব্রিজের সামনে বেলদী সড়কে ১০ শতাংশ জায়গায় নির্মাণকাজ চলছে। তবে র‍্যাব জানায়, এসব সম্পদ ছাড়াও ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট ও দুটি গাড়ি কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ আছে পাপিয়ার।

পাপিয়ার বাবা সাইফুল বারী আগে গণপূর্তের গাড়িচালক ছিলেন। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে সাব্বির আহমেদ নিজের একটি রিকশা গ্যারেজ ও পাপিয়ার কেএমসি কার ওয়াশ রয়েছে। অন্য ছেলে সোহাগ আহমেদ মাদকের ব্যবসা করেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

পাপিয়ার স্বামী সুমনের বাবার নাম মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি নরসিংদীর একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান। সুমনের বিরুদ্ধে মানিক কমিশনার হত্যাসহ চারটি মামলা আছে।

নরসিংদীর বাসিন্দারা জানান, এসএসসি পাসের পর ২০০৯ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন পাপিয়া। কলেজে পড়ার সময় তৎকালীন পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের কর্মী ও স্থানীয় ক্যাডার সুমনের নজরে পড়েন। ২০১১ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকেই দুজনে একত্রে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। স্বামী সুমনের হাত ধরেই পাপিয়ার উত্থান।

নরসিংদী সদরে আওয়ামী লীগের নেতারা স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর আসনের সাংসদ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম এবং অন্য পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া এবং পৌর মেয়র কামরুজ্জামান। এই বিভাজনের পর নিজেদের শক্তি বাড়াতে দুই পক্ষই আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা–কর্মীদের দলে ভেড়ান। এর সুবিধা পান সুমন-পাপিয়া। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে স্থানীয় সাংসদ মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের কর্মী হয়ে নরসিংদীতে নিয়মিত আসতে থাকেন তাঁরা। কেএমসি বাহিনী নিয়ে নজরুলের সব কর্মসূচিতেই উপস্থিত থাকতেন সুমন-পাপিয়া।

জানতে চাইলে নরসিংদী সদর আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পাপিয়া-সুমন কখনোই আমার কর্মী ছিল না, তারা ছিল দুই পৌর মেয়রের কর্মী। আমি কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নেই।’

নরসিংদীর পৌর মেয়র কামরুজ্জামান বলেন, এই পাপিয়া-সুমনকে বিভিন্ন সময় ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের নমুনা ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ইদানীং এ ধরনের অপরাধ চক্রগুলো যেভাবে উদ্ঘাটিত হচ্ছে, তাতে দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে যে রাজনীতি আর অপরাধের জগৎ মিলেমিশে প্রায় এক হয়ে যাচ্ছে। সর্বত্র দলীয়করণের ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদদের হাতে। এ থেকে পরিত্রাণ ক্রমে দুরূহ হয়ে যাচ্ছে, যা শান্তিপ্রিয়, নিরপরাধ জনগণের জীবন ক্রমেই দুর্বিষহ করে তুলবে।