মহাস্থানগড়ে দখল থেমে নেই, দুর্গনগরীর ভেতর ৮০০ স্থাপনা

বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে নতুন নতুন বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে । সম্প্রতি গড় মহাস্থান এলাকায়।  ছবি: সোয়েল রানা
বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে নতুন নতুন বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে । সম্প্রতি গড় মহাস্থান এলাকায়। ছবি: সোয়েল রানা

লালমাটি শুকিয়ে গেলে যে রং ধারণ করে, ইটের পর ইটে সাজানো প্রাচীরের রংটা তেমনই। দুর্গ, পরিখা, প্রাচীন মন্দির, বসবাসের ঘরের নানা নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এটি যে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন!  প্রাচীন পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ এটি। বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের এই নগর এ অঞ্চলের নগরসভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন স্মারক। ‘সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী’ নামে এর তকমা জুটেছিল। প্রায় চার শ একরের মূল দুর্গের যেখানেই খনন হোক, বেরিয়ে আসে ইতিহাসের নতুন নতুন আখ্যান। ইতিহাসবিদদের কাছে এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। আর বাংলাদেশে আসা বিদেশি পর্যটকদেরও বড় আগ্রহস্থল। কিন্তু এই যে নগর বা নগরদুর্গ, এরই মধ্যে কংক্রিট বা সেমি পাকা বাড়ি বা টিনের ছাউনি দেওয়া বাড়ি নির্মাণ চলছে প্রতিদিন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, এমন স্থাপনা আট শর কাছাকাছি। স্থানীয়দের দাবি, এটা তাদের বংশপরম্পরায় পাওয়া সম্পত্তি।

মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্য রক্ষা আর নিজেদের জমি রক্ষার নামে এভাবে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও স্থানীয় মানুষ মুখোমুখি। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যে দেশের প্রাচীনতম এই স্থানটি হারাতে বসেছে জৌলুশ।

প্রাচীন পুণ্ড্রনগরীর ঐতিহ্য সংরক্ষণে হাইকোর্ট ১০ বছর আগে অধিগ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো প্রত্নস্থল এলাকায় অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়নি। পুণ্ড্রনগরের মূল দুর্গ এলাকায় স্থাপনা নির্মাণে বাধা দিতে গিয়ে দখলদারদের হাতে হামলা-মামলার শিকার হতে হচ্ছে, এমন অভিযোগ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। তাঁরা বলছেন, প্রয়োজনীয় লোকবল, সম্পদের অভাবে অধিগ্রহণের কাজ করা হয়নি। তবে সর্বশেষ তাঁরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে প্রায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি পাস হলে সমস্যার সমাধান হবে। 

>

দুর্গনগরীর সীমানার মধ্যেই কংক্রিট বা সেমি পাকা বাড়ি বা টিনের ছাউনি দেওয়া বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে প্রতিদিন

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রাচীন রাজধানী পুণ্ড্রনগরীর আয়তন ৩৯৪ একর। এর মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দখলে রয়েছে মাত্র ৪২ একর। দুর্গপ্রাচীর এলাকায় ২৮ একর সরকারের এবং মাজার এলাকায় ৩ দশমিক ৭০ একর রয়েছে ওয়াক্ফ সম্পত্তি। অবশিষ্ট সম্পত্তি স্থানীয় বাসিন্দাদের দখলে রয়েছে এবং এসব সম্পত্তিতে বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ও কিছু আবাদি জমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখনো প্রত্নস্থল এলাকায় বসতবাড়ি নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেছেন, ‘নগর দুর্গের ভেতরে একের পর এক বাড়ি উঠছে। এর প্রতি ইঞ্চি মাটি খুঁড়লেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মেলে। এসব জায়গা খুঁড়ে, ইট তুলে সেসব দিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে এসব এলাকার মানুষ। আমাদের দাবি, আদালতের নির্দেশ অনুসারে দ্রুত অধিগ্রহণ করা হোক।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের শেষ দিকে  মহাস্থানগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নষ্ট করে স্থাপনা নির্মাণ, মাজার সম্প্রসারণ এবং প্রত্নস্থল খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ চেয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের একটি সংস্থার সভাপতি মনজিল মোরশেদ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বগুড়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে সশরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন এবং মহাস্থানগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চান। পরে আদালতের নির্দেশে গঠিত একটি কমিটির সদস্য ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, শিল্পী হাশেম খানসহ অন্যরা মহাস্থানগড় এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দুর্গনগরী এলাকায় বসবাসকারীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘এলাকাবাসীকে ভুল বুঝিয়ে আমাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। মহাস্থানগড়কে রক্ষায় এখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দরকার।’

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে গত এক দশকে গড় মহাস্থান এলাকায় কয়েক শ নতুন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ চলছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নথিতেই সব মিলিয়ে মহাস্থানগড় প্রত্নস্থল এলাকায় ১১৩টি পাকা বাড়ি, ৫৫৩টি সেমি পাকা স্থাপনা এবং ১৯৬টি কাঁচা বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দুর্গনগরী ও প্রত্নস্থল এলাকায় বসতি রেখে মহাস্থানগড়কে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে ৩১৯ একর ব্যক্তিমালিকানা জমি অধিগ্রহণ এবং নিরাপত্তার জন্য আরও ২০০ আনসার চেয়ে গত ২২ ডিসেম্বর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

অধিগ্রহণে বিলম্ব প্রসঙ্গে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ প্রথম আলোকে বলেন, এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর জন্য অনেক টাকা দরকার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বাজেট তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে জানালেন।