কখন কী খবর আসে, সেই অপেক্ষায়...

ছবির এমন সুন্দর মুহূর্ত আর ফিরবে না।  অগ্নিকাণ্ডে তছনছ হয়ে গেছে পরিবারটি। শিশু রুশদী ঝরে গেছে শুরুতেই। মারাত্মক দগ্ধ বাবা শহিদুল কিরমানি ও মা জান্নাতুল ফেরদৌসী এখন জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।  ছবি: সংগৃহীত
ছবির এমন সুন্দর মুহূর্ত আর ফিরবে না। অগ্নিকাণ্ডে তছনছ হয়ে গেছে পরিবারটি। শিশু রুশদী ঝরে গেছে শুরুতেই। মারাত্মক দগ্ধ বাবা শহিদুল কিরমানি ও মা জান্নাতুল ফেরদৌসী এখন জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ছবি: সংগৃহীত

বুধবার সকালেও দাদা এ কে এম শহীদুল্লাহর হাত ধরে স্কুলে গিয়েছিল পাঁচ বছরের রুশদী। এক দিন বাদে গতকাল শুক্রবার বিকেলে সেই নাতিকে দাফনের জন্য নরসিংদীর পথে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ৬০ ছুঁই–ছুঁই দাদা। আগুনে পোড়া রুশদীর ছোট্ট দেহটি তখন পর্যন্ত রাখা ছিল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিচতলার হিমঘরে। আর মারাত্মক দগ্ধ তাঁর বাবা শহিদুল কিরমানি ও মা জান্নাতুল ফেরদৌসী তখন একই হাসপাতালের পাঁচতলায় জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

গতকাল বিকেলে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে পাওয়া গেল বিহ্বল শহীদুল্লাহকে। অকালে ঝরে গেছে যে নাতি, তার জন্য শোক করার অবকাশও যেন নেই তাঁর। কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন, চোখের কোণে জমে উঠছে অশ্রুর ফোঁটা। কাছে যেতেই বলে উঠলেন, ‘রুশদীকে নিয়ে যাওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ। নরসিংদীর শিবপুরে আমাদের বাড়ির সামনে ওর কবর হবে। কিন্তু ওর বাবা–মায়ের অবস্থাও তো ভালো না। কখন কী খবর আসে, সেই অপেক্ষায় আছি।’

বৃহস্পতিবার দিবাগত ভোররাতে নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের আবাসিক এলাকার একটা পাঁচতলা ভবনে আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিটের এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই বাড়ির দোতলায় বায়িং হাউস চালানো হচ্ছিল। নিচতলায় গ্যারেজের এক পাশে ছিল ওই প্রতিষ্ঠানের গুদাম। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানেই সিঁড়িঘরের বৈদ্যুতিক বোর্ড থেকে আগুন প্রথমে বায়িং হাউসের গুদামে ও পরে গ্যারেজে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে শিশু এ কে এম রুশদীসহ ‘ক্ল্যাসিক ফ্যাশন’ নামের ওই বায়িং হাউসের কর্মচারী আবদুল কাদের (৪৫) ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আফরিন জান্নাত ওরফে জ্যোতি (১৭) মারা যান। দগ্ধ হন রুশদীর বাবা–মা। আর আফরিন জান্নাতের মা লাল বানু ও বাবা গণপূর্তের কর্মচারী জাহাঙ্গীর আলম ছাদ থেকে দড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে গুরুতর আহত হন।

>

অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের একটা কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স

রুশদীর দাদা শহীদুল্লাহ ঢাকায় একটা জাতীয় দৈনিকে জ্যেষ্ঠ উৎপাদন ব্যবস্থাপকের পদে কাজ করেন। দগ্ধ শহিদুল কিরমানি তাঁর একমাত্র ছেলে। তিনি জানান, শহিদুল পুলিশ প্লাজায় ‘ভিআইভিপি এস্টেট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি কোম্পানির ফাইন্যান্স ম্যানেজার। আর তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের অর্থ বিভাগে কাজ করেন। শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আগুন আমার সাজানো বাগানটা শেষ করে দিয়েছে।’
ছেলের সঙ্গে শহীদুল্লাহর শেষবার কথা হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। তিনি বলেন, ‘রনি (শহিদুল কিরমানি) বুঝতে পেরেছে যে রুশদী আর নাই। তাই সে প্রথমে ওকে ঢাকায় কবর দিতে বলেছিল। কিন্তু নিজেদের জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে পরে আমাকে আমার মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে বলে।’

এদিকে আইসিসিউর সামনে এক কোণে বেঞ্চে বসে ছিলেন রুশদীর মামা শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার বোন এখনো রুশদীর মারা যাওয়ার খবর জানে না। আসলে এখন সে কোনো কিছু বোঝার অবস্থাতেই নেই।’

স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, শহিদুল কিরমানিরা ওই ভবনের তৃতীয় তলায় থাকতেন। আগুন লাগার পর প্রাণ বাঁচাতে শহিদুল রুশদীকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে আসছিলেন। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী। কিন্তু ফ্ল্যাট থেকে বের হতে গিয়ে ঘন কালো ধোঁয়ার মধ্যে পড়ে যান তাঁরা। একপর্যায়ে রুশদী শহিদুলের হাত থেকে পড়ে যায়। জান্নাতুলও বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। পরে তিনতলার সিঁড়িতেই রুশদীর লাশ পাওয়া যায়।

এদিকে রুশদীর বাবা–মায়ের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে গতকাল সন্ধ্যায় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদের (শহিদুল ও জান্নাত) দুজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। কোনো আশা দেখতে পারছি না।’ তিনি জানান, আগুনে শ্বাসনালিসহ শহিদুলের শরীরের ৪৩ শতাংশ ও জান্নাতের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

‘ভুতুড়ে’ ভবন
গতকাল বিকেলে দিলু রোডে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পোড়া ৪৫ /এ নম্বর ভবনটির দুটি অংশ। যে অংশে গাড়ির গ্যারেজ সেই অংশের পাঁচতলা পর্যন্ত কালো দাগের আস্তরণ। অন্য অংশ পরিষ্কার। গ্যারেজে পুড়ে যাওয়া পাঁচটি গাড়ি পড়ে আছে। দেয়াল ও ছাদের আস্তরণ খসে পড়েছে। সবখানেই একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ। ভবনটি দেখতে ভিড় করছে অনেক মানুষ।

ভবনটির তত্ত্বাবধায়ক লুৎফর রহমান জানান, ভবনটিতে মোট আটটি পরিবার বাস করত। কিন্তু এ মুহূর্তে কেউ নেই।

এদিকে এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের একটা কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কমিটির প্রধান ও ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবুল হোসেন জানান, তাঁরা এর মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আরও অনেক কিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।