ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় : ভালো নেই সেরা ছাত্রীরা

পিইসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে প্রতিবারই সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।  ফাইল ছবি
পিইসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে প্রতিবারই সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। ফাইল ছবি

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও এসএসসি পরীক্ষা। ছোটদের এই তিনটি পাবলিক পরীক্ষার প্রতিটিতেই চট্টগ্রামে মেয়েদের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। শুধু মেয়েদের ফলে নয়, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক সময় শিক্ষা বোর্ডের সম্মিলিত ফলাফলেও শীর্ষে থাকছে। কিন্তু যাদের কারণে বিদ্যালয়ের এই সাফল্য আর সুনাম—সেই ছাত্রীরা আছে নানা সমস্যায়। দীর্ঘদিন ধরে এসব সমস্যা লেগে থাকলেও দেখার যেন কেউ নেই।

বিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান নিয়ে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের তেমন কোনো প্রশ্ন নেই। তবে শৌচাগার থেকে সুপেয় পানি, পাখা থেকে খেলার মাঠ, সবকিছুতেই যেন সমস্যা আর সমস্যা। অথচ এই বিদ্যালয়টি চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন এবং প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় ধন্য হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বিখ্যাত উপন্যাস ন হন্যতে-এর লেখক মৈত্রেয়ী দেবীসহ প্রখ্যাত নারীদের ছোঁয়ায়।

বিদ্যালয়ের ২০১২ সালের বার্ষিকী অনুযায়ী, চট্টগ্রামের সুচক্রদণ্ডীর চিকিৎসক অন্নদা চরণ খাস্তগীর ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের নেতা। তিনি তাঁর চার কন্যাকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। তাঁর তৃতীয় কন্যা বিনোদিনী খাস্তগীরকে বিয়ে দিয়েছিলেন আইনজীবী যাত্রা মোহন সেনের সঙ্গে। ১৯০৬ সালে বিনোদিনীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য যাত্রা মোহন সেন তার শ্বশুরের নামে চট্টগ্রামের জামাল খানে ১৯০৭ সালে ‘ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে তিনি বিদ্যালয়টি ইংরেজি উচ্চ মানে উন্নীত করতে বিস্তীর্ণ ভূমি ও গৃহ দান করেন। ১৯৬০ সালে বিদ্যালয়টি ‘মাল্টি লিটারেল স্কিমের’ আওতাভুক্ত হয়। ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর চাপে ১৯৬৪ সালে প্রাত শাখা খোলা হয়। মাত্র ৩ জন ছাত্রী দিয়ে শুরু হওয়া শতবর্ষী এই বিদ্যালয়ে এখন ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ২০০।

শৌচাগার আর সুপেয় পানির অভাব

এই বিদ্যালয়ে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাত ও দিবা—এই দুই শিফটে শ্রেণি কার্যক্রম চলে। কিন্তু বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন-১ এবং একাডেমিক ভবন-২ মিলিয়ে শৌচাগার আছে মাত্র ৬টি, শিক্ষার্থীদের তুলনায় যা একেবারেই নগণ্য। আবার এসব শৌচাগারে প্রায় সময় পানি থাকে না।

সম্প্রতি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন শ্রেণির ছয় শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তাদের মধ্যে তিনজন বলে, শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় অনেক সময় শৌচাগার ব্যবহারের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। চেপে রাখার কারণে অনেক সময় সমস্যা হয়। আর দুজন শিক্ষার্থী বলে, নোংরা থাকায় প্রায় সময় এসব শৌচাগার ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাই অনেকেই শৌচাগারে যেতে চায় না।

সুপেয় পানির সংকটও রয়েছে এই বিদ্যালয়ে। ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে সুপেয় ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বাসা থেকে পানি নিয়ে আসে। আর যারা আনে না, তারা সরাসরি টেপের পানি পান করে।

বিশ্রামাগার আর পাখার কষ্ট

বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ পাখাই পুরোনো। কয়েক দিন পরপর এসব পাখা নষ্ট হয়। ইতিমধ্যে অকেজো হয়ে গেছে অন্তত ৩০টি পাখা। শুধু পাখা নয়, অনেক বৈদ্যুতিক বাতিও নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে একদিকে ঠিকমতো বাতাস পাওয়া যায় না, আবার শ্রেণিকক্ষগুলোতে আলো কম থাকে। এ জন্য গরমের সময় হাঁসফাঁস করে শিক্ষার্থীরা।

বিদ্যালয়পড়ুয়া বেশির ভাগ ছাত্রীর সঙ্গে তাদের মায়েরা আসেন। অনেকেই মেয়ে যতক্ষণ বিদ্যালয়ে থাকে, ততক্ষণ অপেক্ষা করেন। কিন্তু তাঁদের জন্য নেই কোনো বিশ্রামাগার। ফলে অভিভাবকদের ফুটপাতে কাগজপত্র পেতে বসতে হয়।

আরও যত সমস্যা

বিদ্যালয়ের বাইরে ওয়ার্ড কাউন্সিলের উদ্যোগে বসার নান্দনিক স্থান করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব বসার স্থান প্রায়ই উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের দখলে থাকে। তাঁরা অনেক সময় ছাত্রীদের টিজ করেন। টিফিন নিয়েও শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। তাদের মতে, যে টিফিন দেওয়া হয়, তা মানহীন। আবার কোনো কোনো শিক্ষক তাঁদের কোচিং সেন্টারে কোচিং করার জন্য শিক্ষার্থীদের জোরাজুরি করেন বলেও অভিযোগ আছে।

তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উল্লিখিত সব সমস্যার কথাই উড়িয়ে দিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহেদা আক্তার। তাঁর দাবি, ছয়টি শৌচাগার স্কুলের জন্য পর্যাপ্ত। তিনি বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ে কোনো সমস্যা নেই। বর্তমানে একটি ভবন পাঁচতলা পর্যন্ত করা হচ্ছে। তখন সব সমস্যা মিটে যাবে।

বিদ্যালয়ে শৌচাগার, সুপেয় পানিসহ নানা সমস্যা রয়েছে বলে জানান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী জালাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষা চলমান থাকায় এখন কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। পরীক্ষা শেষে এসব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’