স্বশিক্ষিত জাহেদুলের বাজিমাত

নিজের তৈরি ইনকিউবেটর দেখাচ্ছেন জাহিদুল ইসলাম। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দীঘিনালার থানা বাজার এলাকায়।  প্রথম আলো
নিজের তৈরি ইনকিউবেটর দেখাচ্ছেন জাহিদুল ইসলাম। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দীঘিনালার থানা বাজার এলাকায়। প্রথম আলো

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাঁর। পড়েছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে টেলিভিশন মেরামত দিয়ে আয়-রোজগার শুরু করেন। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকতে চাননি। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থেকে করেন মুরগি ও কোয়েল পাখির খামার। চেয়েছিলেন খামারেই মুরগি ও কোয়েলের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাবেন। কিন্তু বাজার ঘুরে দেখেন একসঙ্গে এক হাজার বাচ্চা ফোটানো যায় এমন ইনকিউবেটরের (ইনকিউবেটর) দাম প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। টেলিভিশন মেরামত করতে গিয়ে ইলেকট্রনিকস সম্পর্কে ভালোই ধারণা জন্মায় তাঁর। সেই ধারণা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে নিজেই তৈরি করলেন ইনকিউবেটর। খরচ পড়ল মাত্র ২৮ হাজার টাকা। এই যন্ত্রে এখন সফলভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাচ্ছেন তিনি। নিজের তৈরি ইনকিউবেটর বিক্রিও করছেন।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার থানা বাজার এলাকার জাহেদুল ইসলামের (৩৪) গল্প এটি। স্বশিক্ষিত এই যন্ত্রকৌশলীর কথা তাঁর গ্রামের বাইরেও ছড়িয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন ইনকিউবেটর কিনে নিয়ে যান তাঁর কাছ থেকে। এই যন্ত্রে ১০০টি ডিম থেকে ৮০টিরও বেশি বাচ্চা ফোটে। ইনকিউবেটরের পাশাপাশি আলোর ফাঁদ দিয়ে মশা মারার যন্ত্রও তৈরি করেছেন তিনি।

সম্প্রতি থানা বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জাহেদুল ইসলাম বাড়ির উঠানে বসে এক হাজার ডিমের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইনকিউবেটর তৈরি করছেন। মাটিরাঙ্গা উপজেলার ফরহাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি ইনকিউবেটরটি কেনার জন্য বায়না করেছেন। ১০ হাজার টাকা অগ্রিমও দিয়ে গেছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই কথা হয় জাহেদুলের সঙ্গে।

জাহেদুল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পড়াশোনা নবম শ্রেণি পর্যন্ত। পড়াশোনা সেখানেই থামিয়ে দিয়ে জীবিকার তাগিদে ১৯৯৮ সালে টেলিভিশন মেরামতের কাজ শেখেন। এরপর টেলিভিশন মেরামত করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরে মুরগি ও কোয়েলের খামার শুরু করেন। নিজের খামারে কোয়েল উৎপাদন করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। সে জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ইনকিউবেটর কেনার জন্য যান। কিন্তু ইনকিউবেটরের দাম বেশি হওয়ায় তিনি নিজেই তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা থেকে তিনি অটো সার্কিট, তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র, কন্ট্রোলার (নিয়ন্ত্রণ) যন্ত্র, হিটার (তাপের যন্ত্র), ফ্যান (বাতাস দেওয়ার) কেনেন। এরপর একটি পরিত্যক্ত রেফ্রিজারেটরের খোল সংগ্রহ করে ৬০০ ডিমের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ইনকিউবেটর তৈরি করেন। এই যন্ত্রে ১ শটি ডিমের মধ্যে ৮৪টিতে বাচ্চা ফোটে।

এ পর্যন্ত ৩৫টি ইনকিউবেটর বানিয়ে বিক্রি করেছেন জাহেদুল। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে আলোর ফাঁদে মশা মারার যন্ত্রও তৈরি করেছেন তিনি। এ যন্ত্র তৈরিতে তেমন কোনো খরচ পড়ে না। ২ শ টাকায় একটি যন্ত্র তৈরি করা যায়। যন্ত্রটি ব্যবহার করে সাফল্যও পেয়েছেন। এখন কয়েকটি যন্ত্র সরবরাহ করার কাজও পেয়েছেন।

উপজেলার কামাকুছড়া গ্রামের প্রিয়দর্শী চাকমা জাহেদুলের কাছ থেকে ২২ হাজার টাকায় কিনেছেন ৫০০ ডিমের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ইনকিউবেটর। এই যন্ত্রে ৩ শ দেশি মুরগির ডিম রেখেছেন তিনি। আশা করছেন ২৯০টির মতো বাচ্চা ফুটবে ডিম থেকে।

প্রিয়দর্শী চাকমা বলেন, এই যন্ত্রের একটি সুবিধা হলো বিদ্যুৎ চলে গেলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাটারির সাহায্যে যন্ত্র চালু হয়ে যায়। জরুরি কাজে তিনি বাড়ির বাইরে গেলেও যন্ত্রে দেওয়া ডিম নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা থাকে না।

কী আছে ইনকিউবেটর ও মশা মারার যন্ত্রে—জানতে চাইলে জাহেদুল বলেন, এক হাজার ডিমের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ইনকিউবেটর তৈরিতে প্রয়োজন টিনের শেড, ছোট ফ্যান (পাখা), এক শ ওয়াটের বাতি, সেন্সর, ডিম রাখার ট্রে, আর্দ্রতার জন্য হিউমিডিটি যন্ত্র, ছোট মোটর, সাইকেলের চেইন, তাপমাত্রার যন্ত্র ও অটো কন্ট্রোলার।

মশা মারার যন্ত্রে রয়েছে ছোট্ট এলইডি বাতি, ছোট্ট ফ্যান (পাখা), সুইচ, ডিসি সকেট ও ডিসি অ্যাডাপ্টার ও প্লাস্টিকের টিফিন বাক্স। ইনকিউবেটরে ২১ দিনে মুরগি, ১৮ দিনে কোয়েল পাখি, ২৮ দিনে টারকি ও হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব বলে জাহেদুল জানান। তিনি আরও জানান, মশা মারার আলোর ফাঁদের যন্ত্রটি ব্যবহারে মাসে মাত্র ৫ টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়।

রাঙ্গুনিয়ার বগাবিল এলাকার উজ্জ্বল দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ২০১৮ সালে এক হাজার ডিম ফোটানোর জন্য ৩৫ হাজার টাকায় একটি ইনকিউবেটর কিনি জাহেদুলের কাছ থেকে। এই যন্ত্রে প্রায় ২০ হাজার কোয়েল পাখির বাচ্চা ফোটানো হয়েছে। যন্ত্রে ৮ শ ডিম থেকে ৭১৫টি বাচ্চা ফুটেছে।’

বড়াদম এলাকার সুমন চাকমা বলেন, ‘এক বছর আগে জাহেদুলের কাছে আমি ১২ হাজার টাকায় ৩ শ বাচ্চা ফোটানোর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্র বানাই। যন্ত্রটি ভালোই চলছে, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এটি বানানোর আগে ঢাকা থেকে ইনকিউবেটর কিনে এনেছিলাম। কিন্তু সেটি এক মাসের মধ্যে বিকল হয়ে গেছে।’