খননকাজ মন্ত্রিপুত্রের কবজায়

ভবদহের শ্রী নদীর বড় অংশই শুকিয়ে গেছে। সেখানে খেলাধুলা করছে গ্রামের ছেলেরা। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি যশোরের অভয়নগর উপজেলার কালিশাকুল এলাকায়।  ছবি: এহসান-উদ-দৌলা
ভবদহের শ্রী নদীর বড় অংশই শুকিয়ে গেছে। সেখানে খেলাধুলা করছে গ্রামের ছেলেরা। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি যশোরের অভয়নগর উপজেলার কালিশাকুল এলাকায়। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

এবার ভারী বর্ষণ হলে ভবদহে যে কী ঘটে, সে চিন্তায় এখনই কপালে ভাজ পড়েছে বাসিন্দাদের। তাঁদের আশঙ্কা, আগামী বর্ষায় এখানে ভয়াবহ জলবদ্ধতার শিকার হতে হবে। কারণ গত চার বছরে ভবদহে খনন প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও বাস্তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। নদীর তলদেশ আরও উঁচু হয়ে গেছে। এসব কাজের নেপথ্যের নিয়ন্ত্রণ হিসেবে যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনের সাংসদ এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য ও তাঁর ছেলে শুভ ভট্টাচায্যের নাম এখানকার মানুষের মুখে মুখে।

অভয়নগরের টেকা ও  শ্রী নদীর বিভিন্ন এলাকা গত সোমবার ঘুরে দেখা যায়, বুক চিতিয়ে উঁচু হয়ে আছে নদী। কোথাও কোথাও চিরচিরে পানি দেখা গেলেও নদীর বড় অংশই শুকনো। সেখানে গরু-ছাগল চরছে, কোথাও গ্রামের ছেলেরা ক্রিকেটও খেলছে। ভবদহ জলকপাটের (স্লুইসগেট) সামনে শ্রী নদীতে ২১ কপাটের মধ্যে ১৬টি পলির নিচে তলিয়ে আছে। এ অবস্থায় বর্ষায় ভবদহ অঞ্চলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। আগামী জুন থেকে বর্ষার মৌসুম শুরু হবে।

এরইমধ্যে প্রায় ৮০৮ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প নিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ’ নামের এই প্রকল্পে ৬২টি নদী ও খাল পুনর্খনন, খালের ওপর ১৯টি কালভার্ট নির্মাণ, বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ এবং ২০টি স্লুইস গেইট নির্মাণ ও সংস্কারের করার কথা উল্লেখ আছে। যদিও স্থানীয় অধিবাসীরা বিপুল অংকের এই উন্নয়ন প্রকল্পটির পক্ষে না।

স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, কয়েক বছরে ভবদহের খনন প্রকল্পে যে দুর্নীতি হয়েছে, তাতে পুরো টাকাই পানিতে গেছে। নতুন করে ৮০৭ কোটি টাকার প্রকল্পে মন্ত্রী, সাংসদ, ঠিকাদার ও ব্যক্তি বিশেষের বড় আকারে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হবে, ভবদহের জলাবদ্ধতা দূর হবে না।

প্রতিষ্ঠান প্রতিমন্ত্রীর, কাজ করেন তাঁর ছেলে

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নথিপত্রে দেখা গেছে, ভবদহ অঞ্চলের মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর পানি চলাচল নির্বিঘ্নœরাখতে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৪টি প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার পাইলট চ্যানেল খনন কাজ হয়েছে। এ মধ্যে শ্রী নদীতে দুটি খননের কাজ করেছে প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যরে ‘মেসার্স শুভ এন্টারপ্রাইজ’। প্রতিমন্ত্রীর ছেলে শুভ ভট্টাচার্য্যরে নামে এই প্রতিষ্ঠান। শুভর তত্ত্বাবধানে খনন কাজ হয়।

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুভ এন্টারপ্রাইজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করার ক্ষেত্রে কি আইনগতভাবে কোনো বাধা আছে?’ তিনি চলেন, শুভ এন্টারপ্রাইজ তাঁরই ৩০ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান। সেটি ভবদহে দু-একবার কাজ করেছিল। সব সময় যে করে, এটা ঠিক না। রাজনৈতিক কারণে অনেকে এটি নিয়ে নানা কথা ছড়ায়।

>

ভবদহে খননের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও নদীর তলদেশ আরও উঁচু হয়েছে
এবারের বর্ষায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার আশঙ্কা স্থানীয়দের

ভবদহের সব খনন প্রকল্পের ঠিকাদারিতে যে প্রতিমন্ত্রী ও তাঁর ছেলের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তা এখন ওই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে। প্রতিমন্ত্রী ও তাঁর ছেলের ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ কারণে খনন কাজ ঠিকমতো হয়নি বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে অসন্তোষও আছে।

সম্প্রতি অভয়নগর উপজেলার দামুখালী গ্রামের কৃষক কালিদাস হালদারের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় ভবানীপুর এলাকার স্লুইস গেটের ওপর দাঁড়িয়ে। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রীর (প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য) ছেলে নদী কাটার কাজ করেন। সরকারি কাজ, দেখা গেল ৫ ফুট গভীর করার কথা, ২ ফুট গভীর করে মাটি তুলে দিয়ে চলে যায়।’

ভবদহে একাধিক প্রকল্পে দুই কোটি ৯৬ লাখ টাকার চ্যানেল খনন করেছে মেসার্স সনি করপোরেশন ও তানিন ট্রেডার্স। আপন দু ভাইয়ের দুই প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়ার নেপথ্যে প্রতিমন্ত্রীর ছেলের ভুমিকা রয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে তানিন ট্রেডাসের্র ঠিকাদারি লাইসেন্স হয় ২০১৬ সালে। মূলত ওই বছর থেকেই ভবদহে নদী খননের প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়।

তানিন ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী শরিফুল ইসলাম ঠিকাদারিতে মন্ত্রিপুত্রের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেননি। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনিরামপুর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। সে কারণে শুভদা’র সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠতা আছে। বিল নিয়ে ঝামেলা হলে হেল্প নিই, এটুকুই।’

অবশ্য শুভ ভট্টাচার্য্য কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা নাকচ করে দেন। তবে তিনি ২০১৬-২০১৭ সালে হরি নদীতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পাইলট চ্যানেল খনন কাজে আর্থিক সহযোগীতা দিয়ে তাঁর ও তাঁর বাবার সম্পৃক্ত থাকার কথা জানান।

মুক্তেশ্বরী, টেকা ও হরি নদীর একাধিক খনন প্রকল্পে ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকার কাজ করেছে জাকাউল্লাহ অ্যান্ড ব্রাদার্স। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. জাকাউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এই কাজ করেননি।’ তাহলে কি তাঁর লাইসেন্সে কাজটি শুভ ভট্টাচার্য্য করছে—এ প্রশ্নের জবাবে জাকাউল্লাহ বলেন, ‘কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে শুভ ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে, কিন্তু কাজটি করেছে মনির; আমার এক বেয়াই।’

সবাই চায় জোয়ারাধার

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ ভবদহ অঞ্চল। সেখানে ছোট বড় ৫৪টি বিল আছে। এ অঞ্চলের পানি ওঠানামার পথ মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী। কিন্তু সব নদীই এখন কমবেশি ভরাট হয়ে বিলের চেয়ে উঁচু হয়ে গেছে। ফলে বর্ষায় নদীর পানি বিলে ঢুকে সব তলিয়ে যায়। প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় জন্য প্রতি বছরেই আপদকালীন নদী খননসহ নানা প্রকল্প নেয় সরকার। কিন্তু তাতে অর্থের অপচয় ছাড়া ভবদহে জলাবদ্ধতার সমাধান হচ্ছে না।

অবশ্য প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যরে মতে, এগুলো আসলে খনন না, অস্থায়ীভাবে পলি অপসারণ। তিনি বলেন, জোয়ারভাটায় প্রতি বছরই নদীতে পলি হয়। গত দুই-তিন বছর সে পলি কেটে দেওয়া হয়েছে, এখন আবার ভরে গেছে। এই বর্ষার আগে আবার কাটতে হবে।

কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বর্ষার আগে খনন আর সম্ভব নয়। নদীর বর্তমান অবস্থায় বাসিন্দাদের মধ্যে দু:শ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। তারা এই নিশ্চিত ভয়াবহ অবস্থা রক্ষা পেতে পুরোনো ‘টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম)’ বা জোয়ারাধার পদ্ধতির বাস্তবায়ন চায়। এই টিআরএম বা জোয়ারাধার হচ্ছে, পুরোনো কৃষি-পদ্ধতি যাতে মূল নদী-সংলগ্ন একটি নির্বাচিত বিলের তিনদিকে বাঁধ নির্মাণ করে তার একদিক খোলা রেখে বিলে জোয়ারভাটা চালু রাখা হয়। এই পদ্ধতিতে জোয়ারে আসা পলি পর্যায়ক্রমে একটি করে বিলে ফেলে বিল উঁচু করা হয়, পাশাপাশি নদীর নাব্যতাও বৃদ্ধি হয়। দামুখালী গ্রামের কৃষক কালিদাস হালদার বললেন, ‘টিআরএম না হলি এবার বর্ষায় বাড়ি ছেড়ে পালাতি হবে।’

জোয়ারাধার বনাম মাটি কাটার ঠিকাদারি

কিন্তু জোয়ারাধার পদ্ধতি নিয়ে এক সময় এলাকায় বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। এর মধ্যে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি একবার, এরপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বার জোয়ারাধার প্রকল্প বাতিল করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। শুরু থেকেই জোয়ারাধারের বিরুদ্ধে ছিলেন স্বপন ভট্টাচার্য্য। তিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মনিরামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৪  সালে সাংসদ ও পরবর্তীতে মন্ত্রী হয়েও সে অবস্থান বজায় রাখেন স্বপন ভট্টাচার্য্য।

ওই সময়ের কথা উল্লেখ করে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী টিআরএমের বিরুদ্ধে ছিলেন ভোটের স্বার্থে। ওনার আগ্রহ মাটি কাটার ঠিকাদারি। বিনা টেন্ডারে কাজ পান।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জোয়ারাধার পদ্ধতিতে জলাবদ্ধতা দূর করা নিয়ে আগে এলাকায় পক্ষ-বিপক্ষ থাকলেও এখন তা নেই। এখন স্থানীয় সাংসদ, মাঠ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিসহ বাসিন্দাদের অধিকাংশই জোয়ারাধারের পক্ষে।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কাটেঙ্গা গ্রামের কৃষক আব্দুল গফ্ফার বলেন, ‘স্বপন বাবু যতোদিন থাকবেন, ততদিন টিআরএম হতে দেবেন না। টিআরএম হলে তো তাঁর ব্যবসা থাকবে না।’

অবশ্য নিজের আগের অবস্থান পরিবর্তনের কথা জানিয়ে স্বপন ভট্টাচার্য্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার-পাঁচ বছর আগে টিআরএমের বিরোধিতা করেছিলাম, কারণ তখন বিলের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হত না, ভুক্তভোগীরাও চায়নি। তবে ভবদহের ভুক্তভোগী এবং বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টিআরএম ছাড়া জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হবে না।’

সম্প্রতি ভবদহের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ডিপিপিতে ১০৭ দশমিক ৯০ কিলোমিটার নদী পুনর্খনন, ৩০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং, ৬২টি খালের ২৬৪ দশমিক ৫১ কিলোমিটার পুনর্খনন, বিভিন্ন খালের ওপর ১৯টি কালভার্ট নির্মাণ, ৫০ দশমিক ২০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ১টি স্লুইস নির্মাণ ও ১৯টি স্লুইস মেরামত করা, ৫টি ইকোপার্ক নির্মাণ, ১৯ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পরিদর্শন সড়ক নির্মাণ, উন্নয়ন ও মেরামত এবং ১ দশমিক ৪০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতায় ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রায় ৮০৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু হবে না।

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘ডিপিপি একটু সংশোধন হচ্ছে। সেখানে ৬২টি নদী-খাল খননের কথা ছিল। আমরা ৫০টি খননের কথা বলেছি। এই ডিপিপিতে ছোট আকারে টিআরএম হবে। তবে ব্যয় একই থাকছে।’

তবে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতারা বলছেন, বিনা দরপত্রে থোক বরাদ্দ দিয়ে নদী খননের কাজ করা হচ্ছে, এটি কোনো টেকসই সমাধান নয়। এতে মহলবিশেষ এই অর্থ লোপাটের সুযোগ পাচ্ছে। কেবল নদী কেটে নদী কেটে নয়, নদীর প্রবাহ নিশ্চিত করেই নদী বাঁচানো সম্ভব।