মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বায়ুদূষণ কমাতে নির্দেশ মানছে না: পরিবেশমন্ত্রী

মো. শাহাব উদ্দিন
মো. শাহাব উদ্দিন

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, ‘ঢাকার বায়ুর মানের অবনতি ঘটার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ মেগা প্রকল্প নির্মাণ। এ ছাড়া শহরের আশপাশে ইটভাটা থেকে যে ধোঁয়া বের হচ্ছে, তাতেও বায়ুদূষণ হচ্ছে।’

নির্মাণকাজের কারণে বায়ুদূষণ দেখা দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, পরিবেশ রক্ষায় তাদের কাজ পুরোপুরি সম্পাদনের জন্য ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে চূড়ান্ত চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বার্তা সংস্থা ইউএনবির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মো. শাহাব উদ্দিন হতাশা প্রকাশ করে বলেন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হলেও নির্মাণকাজের ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণ হ্রাস করার নির্দেশনা তারা অনুসরণ করছে না।

মন্ত্রী আরও বলেন, সম্প্রতি মেট্রোরেল প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের পরিবেশ অধিদপ্তরে (শুনানি) তলব করা হয়েছিল, তারপরও বায়ুদূষণের মাত্রা অপরিবর্তিত রয়েছে।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় পরিবেশ সংরক্ষণের মতো বিষয়গুলো ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলিত স্বীকার করে শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘ছোট বা বড় প্রকল্প যা–ই হোক না কেন, পরিবেশ রক্ষার জন্য যে নিয়ম রয়েছে, তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে।’

বায়ুদূষণ কমাতে গৃহীত ব্যবস্থার রূপরেখা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আরও বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

তবে মন্ত্রী স্বীকার করেন যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য তাঁদের জনবলের অভাব রয়েছে। পরিবেশমন্ত্রী বলেন ‘আদালতের আদেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের জনশক্তি বৃদ্ধি করছি এবং এখন আরও বেশি অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

মন্ত্রী বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম দেশব্যাপী সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সরকার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবেশ অধিদপ্তরের বর্তমানে অবস্থিত বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয় ছাড়াও নতুনভাবে রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়সহ ৪৩টি জেলায় জেলা অফিস স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে।

ঢাকা শহরের অসহনীয় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার জানিয়ে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে বসে কাজ করার আশ্বাস দেন মন্ত্রী।

শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে আমরা ঢাকাসহ বড় বড় জেলা শহরে বায়ুর মান নিরূপণের জন্য ক্যাম্প স্থাপন করেছি। পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর ও শিল্পঘন শহরে সার্বক্ষণিক বায়ুর গুণগত মান পরিমাপ করা হচ্ছে। পরিমাপকৃত বায়ুর গুণগত মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।

মন্ত্রী আরও বলেন, ২০০২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বায়ুমানের উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল—এই তিন বছর বায়ুর মান বেশি খারাপ হয়েছে। ঢাকায় বিভিন্ন বড় বড় অবকাঠামোগত কাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি হচ্ছে। এ ছাড়া বায়ুদূষণের উৎস হচ্ছে ইটভাটা, রাস্তা, যানবাহন, খোড়াখুড়িসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য।

মন্ত্রী বলেন, ‘ইটভাটার জন্য ঢাকার চারপাশে ৫৮ ভাগ বায়ুদূষণ হয়। আইনের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর দেশে বিদ্যমান ইটভাটাগুলোকে জ্বালানিসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত করতে কাজ শুরু করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ২০২৫ সালের পর পর্যায়ক্রমে বেসরকারিভাবে সব অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ব্লক ইট ব্যবহার বাস্তবায়ন করা হবে।

শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘এ পর্যন্ত দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ ইটভাটা পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এটাকে আমরা ১০০ ভাগে উন্নীত করব।’

পরিবেশমন্ত্রী বলেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী মাটির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে হ্রাস করার উদ্দেশ্যে সব সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কারকাজে ব্লক ইট বাধ্যতামূলক করতে ২০১৯-২০ সালে ১০ শতাংশ ব্লক ইট এবং পর্যায়ক্রমে এটি ২০২৫ সালে শতভাগে ব্লক ব্যবহার করা হবে। তবে এটি সড়ক ও মহাসড়কের বেইজ ও সাববেইজ নির্মাণ ও সংস্কারে বাধ্যতামূলক হবে না।

শাহাব উদ্দিন বলেন, ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে ৭ হাজার ৯০২ হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৮৭টি ইটভাটা ঢাকা বিভাগের মধ্যে গড়ে উঠেছে। ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে মোট যানবাহনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৭। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৫৪।

মন্ত্রীর মতে, বায়ুদূষণের আরেকটি কারণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া। এটিও দিন দিন বাড়ছে। গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিকল্পনা করেছি, গাড়ির কালো ধোঁয়া যেকোনো মূল্যে কমাব। আমরা বিআরটিএসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় এটি বন্ধ করব।’ তিনি বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে দুই সিটি করপোরেশনকে আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে আমরা বলেছি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণসামগ্রী অর্থাৎ মাটি ও বালু পরিবহনের সময় এসবের একটি অংশ রাস্তার ফেলে যাচ্ছে, যা পরবর্তী সময়ে বায়ুদূষণের জন্য বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছে, ’।

বর্জ্য দূষণের পেছনে আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা ও পরিবহনব্যবস্থাকেও দায়ী করেন শাহাব উদ্দিন।

মন্ত্রী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পরিবেশদূষণের দায়ে ১ হাজার ৬৯৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান/প্রকল্প/ব্যক্তির বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম গ্রহণ করে ২০ কোটি ২২ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে।

পরিবেশমন্ত্রী বলেন, অন্যদিকে একই সময়ে পরিবেশগত বিভিন্ন অপরাধের (অবৈধ পলিথিন, ইটভাটা, পাহাড় কর্তন, জলাশয় ভরাট, নির্মাণসামগ্রী, অতিরিক্ত দূষণ প্রভৃতি) বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ১৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা এবং ৪৫৯টি অবৈধ ইটভাটা আংশিক ভেঙে ফেলা হয়েছে।