দৃষ্টান্ত রাখার মতো এক উদ্যোগ

শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ ব্লাড ডোনেশন গ্রুপের সদস্যরা। সম্প্রতি শহরের তল্লা নলেজ প্রি ক্যাডেট স্কুলে।  ছবি: প্রথম আলো
শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ ব্লাড ডোনেশন গ্রুপের সদস্যরা। সম্প্রতি শহরের তল্লা নলেজ প্রি ক্যাডেট স্কুলে। ছবি: প্রথম আলো

নিজের বোন গুরুতর অসুস্থ। দ্রুত রক্ত দিতে হবে। নানাভাবে চেষ্টা করেও কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না কলেজছাত্র রাকিব হোসেন। বহু কষ্টে রক্ত জোগাড় করতে পারলেন। সঙ্গে একটা ভাবনাও মাথায় আসে। তাঁর মতো নিশ্চয় অনেকেই এমন ভোগান্তির শিকার হন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে জরুরি প্রয়োজনের সময় রক্ত দিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো যাবে।

এই ভাবনা থেকে প্রথমে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলেছিলেন নারায়ণগঞ্জ শহরের তল্লা এলাকার বাসিন্দা রাকিব। ধীরে ধীরে সেই গ্রুপ স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটা বড় সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সংগঠনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘নারায়ণগঞ্জ ব্লাড ডোনেশন গ্রুপ’। এই গ্রুপের সদস্য বর্তমানে সাড়ে ১২ হাজার। বিভিন্ন গ্রুপের রক্তদাতা নারী সদস্য আছেন ১ হাজার ৩০০ জন; পুরুষ রক্তদাতা আছেন ৬ হাজার ২০০ জন। তাঁরা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে দিন-রাত যেকোনো সময় অসুস্থ বা মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দান করেন। প্রথম দিকে জেলা শহরের তল্লা ও আশপাশের এলাকার মুমূর্ষু রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে রক্ত সংগ্রহ করে দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল কার্যক্রম। সেই উদ্যোগ এখন বিস্তৃত হয়েছে পুরো জেলায়; এমনকি জেলার বাইরেও দু-একটি এলাকায়।

সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা রাকিব হোসেন বর্তমানে সোনারগাঁ কলেজের স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সংগঠন শুরুর কাহিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন রাকিব। তিনি বলেন, তাঁর বোন ফাতেমা আক্তার কয়েক বছর আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, তাঁর জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কোনো সংগঠন আছে, তা তাঁর জানা ছিল না। ফলে পরিচিতজন যেখানে যাঁকে পাচ্ছিলেন, তাঁকে বলছিলেন। এভাবে অনেক চেষ্টার পর তখন বোনের জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। সেই কষ্টের কথা উপলব্ধি করেই তিনি যাঁরা স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আগ্রহী, তাঁদের নিয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির চিন্তা করেন। প্রথমে ১০-১২ জন সহপাঠীকে নিয়ে ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে খোলেন নারায়ণগঞ্জ ব্লাড ডোনেশন গ্রুপ। প্রথমে অনলাইনের মাধ্যমে এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা চলে। ধীরে ধীরে তা বাড়তে শুরু করে। এভাবে দিনে দিনে পুরোদস্তুর একটা সংগঠন দাঁড়িয়ে যায়। 

বাধা করতে হয়েছে জয়

এই নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতারা বলছেন, শুরুতে তাঁদের অনেকেই পরিবার থেকে বাধার মুখে পড়েন। পরিবার থেকে তাঁদের বলা হয়, ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে’ হবে না। কিন্তু তাঁরা এতে দমে যাননি। উদ্যম আর ব্যাপক উৎসাহের কাছে কোনো বাধাই টেকেনি। উল্টো এখন পরিবারের পক্ষ থেকে এই তরুণদের রক্তদানে উৎসাহিত করা হয়। পরিবারের সদস্যরা যাঁরা আগে কখনো রক্ত দেননি, তাঁরাও তিন মাস পরপর রক্তদানে উৎসাহিত হচ্ছেন।

গ্রুপের সদস্যরা বলেন, তাঁরা শুধু রক্তদাতা খুঁজে দিয়েই বসে থাকেন না, রক্তদাতাকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, রক্তদান পর্যন্ত এবং রোগীর সুস্থ হওয়ার পর্যন্ত খোঁজখবর রাখেন তাঁরা। এরপরও ডোনার ও রোগীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন গ্রুপের সদস্যরা। এমনকি যতবার রক্তের প্রয়োজন পড়ে, ততবারই রক্তের ব্যবস্থা করে দেন তাঁরা।

সংগঠনটির বর্তমানে ৪৫ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। উদ্যোক্তা ও বর্তমান সভাপতি রাকিব হোসেন বলেন, তিনি নিজে মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিয়েছেন ১১ বার। তাঁদের সংগঠন গত দুই বছরে ৬ হাজারের বেশি রোগীকে রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে ৮০ শতাংশ রোগী রক্ত জোগাড় করেন এই গ্রুপের মাধ্যমেই।

রক্তদাতাদের মধ্যে সুপার ডোনার, গোল্ডেন ডোনার ও অ্যাকটিভ ডোনার—এই তিন শ্রেণি করা আছে। সুপার ডোনাররা দিন-রাত যেকোনো সময় মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দান করে থাকেন। অপ্রতুল নেগেটিভ গ্রুপের রক্তদাতারা গোল্ডেন ডোনার। তাঁরা রিজার্ভ ডোনার হিসেবে থাকেন। যখনই কোনো সংকটাপন্ন রোগীর রক্তের প্রয়োজন পড়ে, তখনই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আর অ্যাকটিভ ডোনাররা তিন মাস অন্তর অন্তর নিয়মিত রক্ত দান করে থাকেন। জরুরি সময়ে রক্তদাতা পাওয়া না গেলে তখন কমিটির সদস্যরাই রক্ত দিয়ে থাকেন।

সংগঠনের সদস্য সরকারি তোলারাম কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোসাদ্দিক অর্ণব বলেন, ‘আগে মানুষ রক্ত দিতে চাইত না। তাদের রক্তের গ্রুপও জানত না। আমরা এখন নিজেরাই বিনা মূল্যে মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দিই।’ তাঁদের গ্রুপের সদস্য কেরানীগঞ্জ ও ঢাকায়ও রয়েছে বলে তিনি জানান।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইমরান মাদানী নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘শহরের ভেতরে রক্তের প্রয়োজন হলে দিতে সমস্যা হয় না; কিন্তু জেলার বাইরে রক্ত দিতে হলে ডোনার জোগাড় করে দিতে বেশ কষ্ট হয়। যাঁরা দূরের হাসপাতালে যেতে চান না, তাঁদের তখন ব্লাড ব্যাংক নিয়ে গিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে পরে সেটি হাসপাতালে পৌঁছে দিই আমরাই।’

সংগঠনের অনলাইন গ্রুপে রাকিব, ইমরানসহ তিনজন ‘অ্যাডমিন’ রয়েছেন। এ ছাড়া ‘মডারেটর’ রয়েছেন ৪০ জন। তাঁরা সার্বক্ষণিক গ্রুপের অনলাইন ও অফলাইনে সেবা দেওয়ায় প্রস্তুত থাকে। সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে সাতটি বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সদস্যরা নিজেরা প্রথমে নিজেদের তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করতেন। পরবর্তীকালে তাঁদের এই কাজে উৎসাহী হয়ে সংগঠনে দুজন উপদেষ্টা যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা এই গ্রুপে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন।

লক্ষ্য একটি ব্লাড সেন্টার

ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রক্তের ‘ক্রসম্যাচ’ করতে গিয়ে টাকা লাগে। রক্তের ক্রসম্যাচ চেক করা এবং ব্লাড ট্রান্সফিউশনে ব্লাড ব্যাংকগুলো দেড় হাজার টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। এটা বহন করা অনেক রোগীর জন্য বোঝা। তাই সংগঠনটির পরিকল্পনা রয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে রক্তের ক্রসম্যাচ চেক ও রক্ত ট্রান্সফিউশনের জন্য ব্লাড সেন্টার করা। এতে রোগীদের ক্রসম্যাচ চেক খরচ ও ট্রান্সফিউশন ব্যয় কমে আসবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রায় ১০ লাখ টাকা লাগবে।

সংগঠনের উপদেষ্টা মোশারফ হোসেন বলেন, মানবিক কারণে ভালো লাগা থেকে ওই গ্রুপের সঙ্গে রয়েছেন তিনি। এই সংগঠন শুধু এলাকাভিত্তিক নয়, সেটি ছড়িয়ে পড়েছে জেলা থেকে জেলার বাইরেও। এই কাজে সম্পৃক্ত হতে পেরে আত্মতৃপ্তি পান বলে জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মুমূর্ষু রোগীদের জন্য অনেক
সময় জরুরি রক্তের প্রয়োজন হয়। স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে নারায়ণগঞ্জ ব্লাড ডোনেশন এ কাজে সহযোগিতা করে চলেছে। এটি মানবসেবায় অনন্য এক দৃষ্টান্ত।