বড় ভাই হিসেবে 'সালাম' না পেয়ে ক্ষোভ, তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা

ছুরিকাঘাতে হত্যার শিকার রহমত উল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত
ছুরিকাঘাতে হত্যার শিকার রহমত উল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

রিনা বেগম আর আবদুস সাত্তার দম্পতির একমাত্র ছেলে রহমত উল্লাহ (২২)। মা–বাবার সঙ্গে রাজধানীর মহাখালীর হাজারীবাড়ী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। রহমতের বাবা আবদুস সাত্তার মহাখালীতে কাঁচামালের ব্যবসা করেন। আর ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা করতেন রহমত উল্লাহ।

রহমতের চাচাতো ভাই শফিকুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবার রহমতের সঙ্গে মহাখালীর একটি মসজিদে একসঙ্গে নামাজ পড়েন তিনি। তারপর রহমত চা খেতে যান মহাখালীর আমতলায়। সেখানে আসেন একই এলাকার অনন্ত নামের এক তরুণ। বড় ভাই হিসেবে অনন্তকে সালাম দেননি রহমত। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে রহমতকে ছুরিকাঘাত করেন অনন্ত। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে রহমত মারা যান।

এই খুনের ঘটনায় রহমতের বাবা আবদুস সাত্তার বাদী হয়ে অনন্তকে আসামি করে রাজধানীর বনানী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলা করার তিন দিনের মাথায় গ্রেপ্তার হয়েছেন একমাত্র আসামি অনন্ত। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত অনন্তকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন।

একমাত্র ছেলে রহমত উল্লাহ খুনের ঘটনায় পাগলপ্রায় তাঁর মা রিনা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রহমত উল্লাহ নরসিংদীতে কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে হাফেজ হয়েছে। পরে মহাখালী এলাকায় ফিরে ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা শুরু করে। সে কোনো গ্রুপের ভেতর ছিল না। কোনো আড্ডায় যেত না। একমনে ব্যবসা করত।’ একই কথা বলেন রহমতের বাবা ছাত্তার।

রহমত খুন হওয়ার বিষয়ে রিনা বেগম বলেন, আগে কখনো তিনি অনন্তের নাম শোনেননি। তাঁর ছেলেও কোনো দিন অনন্তের নাম বলেননি। অনন্তরা এক পাড়ায় থাকেন, আর তাঁরা অন্য পাড়ায় থাকেন। শুক্রবার তাঁর ছেলের দোকান বন্ধ ছিল। রাত আটটার দিকে দুই বন্ধুর সঙ্গে মহাখালীর আমতলীতে যান রহমত। সাড়ে আটটার দিকে তিনি তাঁর ছেলের মোবাইল নম্বরে ফোন দেন। তখন মোবাইল বাজতে থাকে। কেউ ধরছিল না। পরে জানতে পারেন, বড় ভাই হিসেবে অনন্তকে সালাম না দেওয়ায় তাঁর ছেলেকে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে।

মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এস এম আহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, রহমত উল্লাহ খুন হওয়ার পর খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন—এলাকায় কোনো প্রকারের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি। ব্যবসায়িক কাজেই সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। অন্যদিকে, অনন্ত বখাটে ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। খুনের কারণ হিসেবে জানতে পারেন, বড় ভাইকে সম্মান হিসেবে সালাম না দেওয়ার কারণে অনন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে রহমতকে ছুরিকাঘাতে খুন করেছেন।

মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক আবু সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় ভাই হিসেবে সম্মান না করার কারণে রহমত উল্লাহকে খুন করেছে আসামি অনন্ত। ও লেভেলে পাস করার পর আর কোনো লেখাপড়া করেনি অনন্ত। আদালতের অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে খুনের কারণসহ সব ধরনের তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

মামলার দুজন তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনন্তের বাবা বেঁচে নেই। অনেক আগে দুর্ঘটনায় তাঁর বাবা মারা যান। মায়ের সঙ্গে মহাখালীতে নিজেদের ফ্ল্যাটে বসবাস করেন তিনি। তবে কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না অনন্ত।

ছুরিকাঘাতে হত্যায় অভিযুক্ত অনন্ত। ছবি: সংগৃহীত
ছুরিকাঘাতে হত্যায় অভিযুক্ত অনন্ত। ছবি: সংগৃহীত

যে ছুরি দিয়ে রহমতকে খুন করা হয়েছে, সেই ছুরি জব্দ করেছে পুলিশ। ঢাকার আদালতে এক প্রতিবেদন দিয়ে পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) শাখা বলেছে, অনন্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে চাঁদপুরে তাঁর খালার বাসা থেকে। জিজ্ঞাসাবাদে অনন্ত স্বীকার করেন, রহমতকে যে ছুরি দিয়ে তিনি খুন করেন, পরে ছুরিটি রেখেছিলেন মহাখালীর গাউসুল আজম মসজিদের পশ্চিম পাশের দেয়ালের পাশে। পরে সেই ছুরি জব্দ করা হয়েছে।

নিহত রহমতের মা রিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের কোনো দোষ নেই। অথচ বিনা কারণে বিনা দোষে আমার ছেলেকে অনন্ত খুন করল। আমি অনন্তের ফাঁসি চাই। আর কিছু চাই না। আমার জীবনসংসার তছনছ করে দিয়েছে অনন্ত।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর–তরুণদের একাংশ রাত জেগে ইন্টারনেটসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাচ্ছে। তরুণদের একটা অংশ মাদকাসক্ত। এই তরুণেরা খুনসহ নানা ধরনের নৃশংস অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তরুণ–কিশোরদের অপরাধ কমানোর জন্য সরকারসহ সবাইকে বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে এখনই।’

এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ইমন নামের এক কিশোর খুন হয়। ওই খুনের ঘটনায় আরেক কিশোর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এবং শিশু আদালতের বিচারিক নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে সব মিলিয়ে ঢাকায় ৯৯ খুনের মামলায় তিন শর বেশি কিশোর জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে।