ব্রুনেইয়ের সুলতানের মতো চলাফেরা তাঁর

ব্রুনেইয়ে নিজের বিলাসবহুল গাড়ির সামনে মানব পাচারের হোতা মেহেদি হাসান।  ছবি: সিআইডি
ব্রুনেইয়ে নিজের বিলাসবহুল গাড়ির সামনে মানব পাচারের হোতা মেহেদি হাসান। ছবি: সিআইডি

সিআইডি ভবনের দোতলায় বিশেষ সুপারের কক্ষে উপচে পড়া ভিড়। কেউ এসেছে টাঙ্গাইল থেকে, কেউ ময়মনসিংহ, কেউবা এসেছে উত্তরের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। মানব পাচার চক্রের তিন সদস্য ধরা পড়েছেন। খবর শুনে ভিড় করছে প্রতারণার শিকার হওয়া মানুষ ও তাঁদের স্বজনেরা।

সিআইডি বলছে, ব্রুনেইয়ে মানব পাচারের অভিযোগে তারা আবদুর রহিম ওরফে রহিম বস, ইসমাইল সরদার ও শাহিন মাতবর নামের তিনজনকে সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করেছে। চক্রটি পাঁচ হাজারের বেশি নিরীহ মানুষকে ব্রুনেইয়ে পাচার করেছে। চক্রের হোতা মেহেদি হাসান ওরফে বিজন এখনো ধরা পড়েননি। ব্রুনেই থেকে বহিষ্কারের পর তিনি দেশে আছেন। ব্রুনেইয়ে থাকার সময় তিনি চলাফেরা করতেন সে দেশের সুলতানের মতো। সুলতানের ছেলের মতো বুলেটপ্রুফ হামার এইচ-২ গাড়িও চালান তিনি। সেই গাড়ির নম্বর তাঁর মুঠোফোন নম্বরের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার সামসুন নাহার জানান, মানব পাচারের হোতা মেহেদি হাসানের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্রুনেইয়ের হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন গত ৩ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘুরে সেই প্রতিবেদন আসে সিআইডির হাতে। তদন্তে নেমে কেঁচো খুঁড়তে সাপের খোঁজ পান সিআইডি কর্মকর্তারা। এরপর তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের খবর শুনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মানুষ আসতে থাকে। সবারই অভিযোগ, কাজ দেওয়ার নামে বিদেশে নিয়ে প্রতারণা করেছে এই চক্র।

মঙ্গলবার সিআইডিতে অভিযোগ দিতে আসা কামাল হোসেন বলেন, মেহেরপুরের মুজিবনগরের জাতারপুর গ্রামের মোস্তাকিম হোসেনের ছেলে মেহেদি হাসান ১৭-১৮ বছর আগে শ্রমিক ভিসায় ব্রুনেই যান। সেখানে থাকার সময় মালয় ভাষা শেখেন। এরপর নুরহানিয়া লিন নামের এক নারীর সঙ্গে মিলে ‘মাস ডিজা এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি’ নামের একটি কোম্পানি খোলেন। ব্রুনেইয়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা সেই কোম্পানির গোপন অংশীদার। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ভারতীয় নাগরিক ওমর আলী খান, আলী আশরাফ ও পাকিস্তানের মালেক মোজাহার। তাঁরা নিজেদের কোম্পানির নামে কাগজপত্র বানিয়ে ভিসা বের করে লোক নিতে শুরু করেন। সাত-আট বছরে তাঁরা পাঁচ হাজারের বেশি লোককে অবৈধভাবে ব্রুনেই নিয়ে যান। মেহেদি নিজেকে ব্রুনেই আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক বলে পরিচয় দিতেন।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, মেহেদি হাসানের হয়ে ঢাকায় কাজ করতেন আবদুর রহিম, ইসমাইল সরদার, শাহিন মাতবর, ইলিয়াস মাঝি ও শাহেদ মজুমদার। তাঁরা জনপ্রতি সাড়ে তিন থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে লোকদের ব্রুনেই নিয়ে যেতেন।

>মূল হোতা মেহেরপুরের মেহেদি বহিষ্কৃত হয়ে এখন দেশে। তিন সহযোগী সিআইডির হাতে।

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, গত বছর পর্যন্ত দেশটিতে বৈধভাবে গিয়েছেন প্রায় ৭৫ হাজার কর্মী। শুধু গত বছরই যান ৩ হাজার ৬২৮ জন। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি আছেন, বাকিরা ফেরত এসেছেন বা অন্য দেশে চলে গেছেন।

ব্রুনেইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনারের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, কিছুদিন আগে ১৩৫টি ভিসা সত্যায়ন করতে দূতাবাসে আসেন মেহেদি হাসান। দেখা যায়, এসব ভিসার বিপরীতে কোনো কাগজপত্র নেই। সবই জাল। তাঁর বিরুদ্ধে এমন ১২টি অভিযোগ জমা পড়ে দূতাবাসে। পাচার হওয়া লোকেরা দূতাবাসে এসে জানান, ব্রুনেইয়ে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কাউকে বিদেশি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আবার কাউকে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়। মেহেদির লোকেরা ব্রুনেইয়ে আসা শ্রমিকদের মাদক ব্যবসা ও ভিক্ষা করতে বাধ্য করেন। মাদক কেনাবেচার অভিযোগে ব্রুনেই সরকার ১০ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে, যাঁদের দুজনের কারাদণ্ড হয়। এসব অভিযোগে মেহেদি হাসান ও তাঁর সঙ্গী শাহেদ মঞ্জুরকে কালো তালিকাভুক্ত করে বহিষ্কার করে ব্রুনেই।

মেহেদির গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবারের লোকেরা আগে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। মেহেদি কিছুদিন আগে গ্রামে একটি বাড়ি করেন। সম্প্রতি মেহেরপুরে এক মন্ত্রীর সফরের সময় মেহেদি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। গতকাল চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।