সপ্তম শতাব্দীর গুপ্ত রহস্য

ভাসুবিহারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চলছে। গতকাল দুপুরে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায়।  ছবি: সোয়েল রানা
ভাসুবিহারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চলছে। গতকাল দুপুরে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায়। ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়ার ঐতিহাসিক ভাসুবিহারে প্রত্নখননে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর বিলুপ্ত সভ্যতার বসতিচিহ্ন, স্থাপত্যকাঠামো ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অস্তিত্ব মিলেছে। মিলেছে পোড়ামাটির তৈরি গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি অঙ্কিত টেরাকোটা, পোড়ামাটির রাজহংস প্রতিকৃতি অঙ্কিত ফলক এবং অলংকৃত ইট।

চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ সালে সম্রাট হর্ষবর্ধনের আমলে ভাসুবিহার ভ্রমণে এসে এখানে ‘পো-সি-পু’ মানে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং সেখানে ৭০০ বৌদ্ধ ভিক্ষু বা শিক্ষার্থী রয়েছে বলে তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন। আলেকজান্ডার কানিংহামও হিউয়েন সাংয়ের দাবিকে সমর্থন করেন।

 ভাসুবিহার প্রত্নখননে দশম থেকে একাদশ শতাব্দীর প্রত্নরহস্য উন্মোচিত হয়েছে অনেক আগেই। এরপর থেকে ভাসুবিহারে এক যুগ ধরে চলছে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাংয়ের দেখা সেই ৭০০ ভিক্ষুর বৌদ্ধবিহারের সন্ধানে প্রত্নখনন। ধারাবাহিক সেই প্রত্নখননে ২৬ ও ২৯ কক্ষবিশিষ্ট দুটি বিহার, একাধিক মন্দির, ছোট–বড় কয়েকটি প্রত্নস্তূপসহ (সমাধিসৌধ) দশম ও একাদশ শতাব্দীর নানা প্রত্নস্থাপনা ও বসতিচিহ্নের সন্ধান মিলেছে। হিউয়েন সাংয়ের দেখা সেই ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর ৭০০ ভিক্ষুর বৌদ্ধবিহারের সন্ধানে ভাসুবিহারে চলছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে দুই মাসব্যাপী প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ। ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই প্রত্নখনন চলবে মার্চ মাসজুড়ে। 

খননকাজের মাঠ পরিচালক এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানার নেতৃত্বে পরিচালিত এবারের প্রত্নখননে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর বিলুপ্ত সভ্যতার বসতিচিহ্ন, স্থাপত্যকাঠামো ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অস্তিত্ব মিলেছে।

খননে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে বিলুপ্ত সভ্যতার নানা মূল্যবান প্রত্নবস্তু ও স্থাপত্য নিদর্শন। 

খননে বেরিয়ে আসা অলংকৃত ইট।
খননে বেরিয়ে আসা অলংকৃত ইট।

নাহিদ সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় ৫৭ বিঘা আয়তনবিশিষ্ট ভাসুবিহারে এবারের প্রত্নখনন চলছে কার্যত হিউয়েন সাংয়ের দেখা ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর সেই ৭০০ ভিক্ষুর বৌদ্ধবিহারের সন্ধানে। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর বসতিচিহ্নের অস্তিত্ব মেলায় খুব শিগগির হিউয়েন সাংয়ের দেখা ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর ৭০০ ভিক্ষুর বৌদ্ধবিহারের সন্ধানও মিলবে বলে আমরা আশাবাদী। এবারের প্রত্নখননে সমুদ্র সমতল ২৫ দশমিক ২৫ মিটার উচ্চতায় মিলেছে অলংকৃত ইট আর ২৫ দশমিক ৪৫ মিটার সমুদ্র সমতল উচ্চতায় রাজহংসখচিত টেরাকোটার ফলক।

১৮৭৫ সালে ভারতবর্ষে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ গঠনের পর মেজর জেনারেল আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম প্রত্নখনন করতে এসে হিউয়েন সাংয়ের দেখা সেই ৭০০ ভিক্ষুর বৌদ্ধবিহারকেও ভাসুবিহার বলে সমর্থন করেন।

২ মার্চ সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে ভাসুবিহারে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশনায় চলছে এবারের খননকাজ।

খননকারী দলের গবেষণা সহকারী সঞ্জয় কুমার রায় বলেন, ‘ভাসুবিহারের ইতিহাস জানিয়ে দেয়, বঙ্গীয় এই বদ্বীপ কতটা সমৃদ্ধ। হিউয়েন সাং যে সমৃদ্ধ ও জীবন্ত বিহারে ৭০০ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে দেখেছিলেন, সেই বিহারের সন্ধানেই চলছে এবারের খননকাজ। কারণ, ইতিপূর্বে সন্ধান পাওয়া ২৯ ও ২৬ কক্ষের দুটি বিহারে ৭০০ ভিক্ষুর বসবাস অসম্ভব। এ কারণে আরও একটি বিহারের গুপ্ত রহস্য উদ্‌ঘাটনের কাজ চলছে। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর বসতিবিন্যাসের চিহ্ন পাওয়ায় ৭০০ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে একসঙ্গে দেখা হিউয়েন সাংয়ের সেই বিহারের রহস্য উদ্‌ঘাটন এখন সময়ের অপেক্ষামাত্র।