অপরাধীরা বেছে নেয় সিসি ক্যামেরা অকেজো এলাকা

চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও প্রবেশমুখে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা আছে ১০৪টি। দূর থেকে সম্ভাব্য অপরাধ ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য ছয় বছর আগে এই ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। কিন্তু ছয় মাস ধরে বেশির ভাগ সিসি ক্যামেরাই অচল পড়ে আছে। অনেক জায়গায় ক্যামেরাও নেই। গত রোববার পুলিশের তালিকা অনুযায়ী ১০৪টি ক্যামেরার মধে৵ সচল রয়েছে মাত্র ২৫টি। নষ্ট পড়ে আছে ৭৯টি ক্যামেরা।

চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ততম ২ নম্বর গেটে গত শুক্রবার রাতে পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন আহত হন। ঘটনার আগে বিস্ফোরকটি বক্সের ভেতর কে বা কারা রেখে যায়। ছুটির দিন হওয়ায় বন্ধ ছিল আশপাশের দোকান। লোকসমাগম ছিলও কম। বিস্ফোরকটি পুলিশ বক্সের ভেতর কে বা কারা রেখে যায়, তা এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়নি। এ মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিসি ক্যামেরা নষ্ট এমন এলাকাকে বিস্ফোরণের জন্য বেছে নেয় হামলাকারীরা, যাতে কেউ ধরা না পড়ে।

এ ঘটনায় করা মামলার তদারককারী কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের প্রধান উপপুলিশ কমিশনার হাসান মো. শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ব্যস্ততম ওই এলাকায় থাকা চারটি সিসি ক্যামেরা সচল থাকলে খুব সহজেই অপরাধীকে শনাক্ত করা যেত। এখন অন্ধকারে সাঁতরাতে হচ্ছে।

২০১৬ সালে নগর থেকে অবৈধ বিলবোর্ড সরিয়ে নেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এতে কাটা পড়ে সিসি ক্যামেরার কেব্‌ল। এ ছাড়া উড়ালসড়ক নির্মাণের সময়ও নষ্ট হয়ে যায় অনেক ক্যামেরা।

২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নগরের কোতোয়ালি থানার হাজারী লেন এলাকা থেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সিসি ক্যামেরা না থাকায় কে বা কারা তাঁকে নিয়ে যায়, তা ধরা পড়েনি। পরে মৃদুলকে কুমিল্লায় ফেলে যায় অপহরণকারীরা। কারা তাকে তুলে নিয়েছিল, আজও তা বেরিয়ে আসেনি। মূলত ওই ঘটনার পর নগরে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেয় পুলিশ।

২০১৪ সালে নগর পুলিশ প্রথম ধাপে ১১০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে। স্থাপিত এসব ক্যামেরায় ধারণ করা ছিনতাই, অপহরণ, খুনসহ যেকোনো অপরাধমূলক দৃশ্য দেখে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার জন্য নগর পুলিশে খোলা হয় ২৪ ঘণ্টার নিয়ন্ত্রণকক্ষ।

২০১৬ সালের ৫ জুন নগরের জিইসি মোড় এলাকায় সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম হত্যায় জড়িত আসামিদের শনাক্ত করা হয় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে। আসামিরা কেউ হেঁটে আর কেউ মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। সিসি ক্যামেরা থাকায় সহজে তা ধরা পড়ে। এভাবে খুন, ছিনতাইসহ একাধিক ঘটনায় অপরাধী শনাক্তে কাজে লাগে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ।

২০১৭ সালের ১ মে নগরের গোলপাহাড় মোড় থেকে অটোরিকশায় চড়ে বাসায় যাওয়ার কথা থাকলেও পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় চলে যায় নগরের একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসফিয়া আমিন। পরদিন সৈকতে তার মরদেহ পায় পুলিশ। তাসফিয়া কোন অটোরিকশায় চড়ে পতেঙ্গায় পৌঁছেছিল, সেই গাড়ির হদিস পায়নি পুলিশ। কারণ, সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোর সিসি ক্যামেরা অকেজো ছিল। আর তাসফিয়া কীভাবে গোলপাহাড় মোড় থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে গেল, সেই প্রশ্নের উত্তরও তদন্তে উঠে আসেনি।

পুলিশের তালিকা অনুযায়ী, নগরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিউমার্কেট, জিইসি, মুরাদপুর, আকবর শাহ, বহদ্দারহাট, চকবাজার, দেওয়ানহাট ব্রিজ, ইস্পাহানি মোড়, অলংকার মোড়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, নিমতলী বিশ্বরোড, টেরিবাজার মোড়, কাজীর দেউড়ি মোড়ে চারটি করে সিসি ক্যামেরা থাকলেও সব কটি নষ্ট। নন্দনকাননে অবস্থিত শহীদ মিনার এলাকায় থাকা আটটি সিসি ক্যামেরাই অচল। এভাবে সাকল্যে ৭৯টি সিসি ক্যামেরা অচল পড়ে আছে। 

সরেজমিন দেখা যায়, নগরের অক্সিজেন মোড় এলাকায় থাকা তিনটি ক্যামেরার তিনটিই নষ্ট। এটি নগরে প্রবেশের অন্যতম পথ। মোড়ের এক দোকানদার প্রথম আলোকে বলেন, দিনে–রাতে যানজট লেগে থাকে। ছিনতাইও হয়। সিসি ক্যামেরা থাকলে এসব বিষয় সহজে ধরা পড়ত। একই অবস্থা নগরের প্রবেশপথ সিটি গেট, মইজ্জারটেক এলাকায়।

অপর দিকে সচল রয়েছে ওয়াসা মোড়ে থাকা ৩টি, আদালত ভবন এলাকার ৬টিসহ মোট ২৫টি সিসি ক্যামেরা।

নগর পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআইতে কর্মরত ১০ জন তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, দুর্বৃত্তরা অপরাধ করে যাতে দ্রুত পালিয়ে যেতে না পারে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তা দ্রুত শনাক্ত করা যায়। গাড়ির নম্বর পাওয়া গেলে ওই গাড়ি কক্সবাজার, ঢাকা কিংবা রাঙামাটি সড়কে গেছে কি না, তা সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে শনাক্ত করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে অপরাধীদের খুঁজে বের করা অনেকটা সহজ হয়।

বেশির ভাগ সিসি ক্যামেরা নষ্ট থাকার কথা স্বীকার করেছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) শ্যামল কুমার নাথ। সোমবার তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দ্রুত নষ্ট ক্যামেরাগুলো সচলের কাজ শুরু হয়েছে। 

এই পুলিশ কর্মকর্তা এমন দাবি করলেও সরেজমিনে দেখা গেছে, অচল সিসি ক্যামেরাগুলো এখনো সচল হয়নি।