বেশি ছিনতাই শাহবাগে, আট বছরে নিহত ৩৬

ঢাকা মহানগরীতে সবচেয়ে বেশি ছিনতাই হয় শাহবাগ এলাকায়। এই এলাকার আটটি স্থানে ভোরে তৎপর হয়ে ওঠে ছিনতাইকারী চক্র। গত আট বছরে শুধু শাহবাগেই ৮৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে।     

মামলার নথিপত্রে দেখা গেছে, শাহবাগ মোড়, মৎস্য ভবন মোড়, প্রেসক্লাবের সামনে, রেল ভবনের সামনে, হাইকোর্ট মাজার মোড়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে, টিএসসি মোড় এবং বাংলা একাডেমির সামনের সড়কে বেশি ছিনতাই হয়।

শাহবাগে কেন বেশি ছিনতাই হয়? সে প্রশ্নের জবাবে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আরিফুর রহমান সরকার বলেন, শাহবাগ শহরের ব্যস্ততম এলাকা। রাস্তাগুলো চওড়া, এখন দিয়ে সবদিকে যাওয়া যায়। ছিনতাই করে সহজে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় ছিনতাইও বেশি হয়।

ঢাকা মহানগরে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। বিগত তিন মাসে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন চারজন। এ সময়ে ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েছেন আরও ৩০ জন। তবে প্রকৃত ছিনতাইয়ের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি। 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাইয়ের যত ঘটনা ঘটছে, সেই হিসাব পুলিশের হিসাবে আসে না। ছিনতাইয়ের শিকার হয়েও অধিকাংশ লোকে মামলা করে না। ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে।

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্যে দেখা গেছে, গত আট বছরে (২০১২ সাল থেকে) ঢাকা মহানগর এলাকায় ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ৮৪৬টি। এ সময় ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন মোট ৩৬ জন। ২০১৮ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মামলা হয় ৭৮টি। গত বছর (২০১৯) তা বেড়ে হয় ১১৯টি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও গণসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন,  আগের থেকে মামলা নেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে এবং সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। থানা-পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও মাঠে কাজ করছে।     

ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হওয়া ৩৬ জনের মধ্যে তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এবং হাতিরঝিল এলাকায় ছয়জন খুন হন। যাত্রাবাড়ী ও শাহবাগে তিনজন করে এবং মিরপুর, ওয়ারী, বাড্ডা, খিলক্ষেত ও হাজারীবাগে দুজন করে খুন হন। দক্ষিণখান, বনানী, গুলশান, উত্তরা, ধানমন্ডি, খিলক্ষেত, দারুসসালাম, নিউমার্কেট, রমনা, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, সবুজবাগ এবং খিলগাঁও এলাকায় একজন করে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন।   

তারিনা বেগম নামের এক নারী গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ভোর পাঁচটার দিকে স্বামী-সন্তানের সঙ্গে রিকশায় করে রাজারবাগ থেকে যাচ্ছিলেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। দক্ষিণ মুগদায় আসার পর প্রাইভেটকারে ওত পেতে থাকা সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীরা হঠাৎ তাঁর ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে মারা যান তারিনা।

এর আগে গত ৬ জানুয়ারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিজানুর রহমানকে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীরা বনানী থেকে অটোরিকশায় তুলে নিয়ে খুন করে। পরে তাঁর লাশ ফেলে রেখে যায় হাতিরঝিলের উড়ালসড়কের ওপর।

মিজানুর খুন হওয়ার দুই দিন আগে গত ৪ জানুয়ারি টেইলারিং মাস্টার মনির হোসেনকে খিলক্ষেতের কুড়িল উড়ালসড়কের ওপর খুন করে লাশ ফেলে রেখে যায় ছিনতাইকারীরা।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খিলক্ষেত থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোফাখখারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মনির হোসেন খুনের ঘটনায় জড়িত দুজন ছিনতাইকারী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সংঘবদ্ধ এই ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যসংখ্যা পাঁচ থেকে ছয়। ছিনতাইয়ে বাধা দিলে তাঁরা খুন করে লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

৩৬টি খুনের মধ্যে ১৫টি মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, চারটি খুনের ঘটনায় ঘটেছে ভোরবেলায়। ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার সময় দুজন নারী এবং একজন শিশু খুন হয়। নগদ টাকা নিয়ে ফেরার সময় ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন তিনজন। যাত্রীবেশে গাড়িতে তুলে আরও চারজনকে খুন করে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা। এর বাইরে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় দুজন চালক খুন হন।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন ইমরান হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তাঁর মোবাইল ফোনটি ছিনতাই হয়। রূপনগর এলাকায় খোকন শেখ নামের এক ব্যক্তিকে মারধর করে তাঁর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা।

গত ১১ জানুয়ারি কামরুল হাসান নামের এক ব্যক্তি ৩৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য কারওয়ান বাজারের উত্তরা ব্যাংকের সামনে আসেন। মোটরসাইকেলে করে আসা সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীচক্রের সদস্যরা কামরুলকে মারধর করে ৩৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। মামলার বাদী মামুন উর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীদের কয়েকজন ধরা পড়লেও টাকা ফেরত পাননি।

গত বছরের ৫ ডিসেম্বর র‍্যাব পরিচয়ে পিস্তল ঠেকিয়ে রাজধানীর ওয়ারী এলাকার টিপু সুলতান রোডে শফিউল আলম আজাদসহ তিনজনকে গাড়িতে ওঠান অজ্ঞাত আসামিরা । তাঁদের কাছে নগদ সাড়ে পাঁচ লাখ টাকাসহ মোবাইল ফোনে কেড়ে নেন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এসআই সৈয়দ রাশেদুল আলম গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

শাহবাগ ছাড়াও ছিনতাইপ্রবণ এলাকার মধ্যে ওয়ারী থানাধীন টয়েনবী সার্কুলার রোড, খিলগাঁও নাগদারপাড় বাইপাস বিশ্বরোড, কল্যাণপুর বাসস্টান্ডের সামনের সড়ক, ধানমন্ডির সিটি কলেজের সামনের রোড, ঢাকা–ময়মনসিংহের কুড়িল উড়ালসড়ক, ফার্মগেট হয়ে খেজুরবাগান মোড় পর্যন্ত, আগারগাঁও পাসপোর্ট থেকে শ্যামলির মোড়, রমনার হাতিরঝিল থেকে মগবাজার মোড়, বারডেম থেকে হোটেল শেরাটন মোড়, এলেনবাড়ী উড়ালসড়ক, যাত্রাবাড়ীর ঢাকা–চট্টগ্রাম হাইওয়ে সড়ক (শনির আখড়া) উল্লেখযোগ্য।

বিগত আট বছরের সংগঠিত ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকার সিএমএম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শাহবাগ, রমনা, যাত্রাবাড়ীসহ মোট ১৫টি থানা এলাকায় ছিনতাই অপেক্ষাকৃত বেশি। এসব এলাকা হচ্ছে খিলগাঁও, ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর, ওয়ারী, উত্তরা, বনানী, পল্টন, মতিঝিল, বাড্ডা, রামপুরা, তেজগাঁও ও সবুজবাগ।

ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাই বাড়ার প্রধান একটি কারণ বেকারত্ব। বেকারত্ব বাড়ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ছিনতাই বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ছিনতাইয়ের সঙ্গে খুনের ঘটনা ঘটছে, যা খুবই উদ্বেগের।