ত্বকী হত্যার সাত বছর: তদন্তকারীরা নীরব, আসামিরা সরব

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী।
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী।

কার নির্দেশে, কোথায়, কীভাবে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী খুন হয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে সবই জানিয়েছিল র‍্যাব। হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আজমেরী ওসমান তখন আত্মগোপনে ছিলেন। র‍্যাবের তৎপরতা থেমে গেলে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের ভাতিজা এবং নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী প্রতি মাসের ৮ তারিখে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মোমবাতি প্রজ্বালন করছেন।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ অপহরণের দুই দিন পর ত্বকীর লাশ উদ্ধার হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীর শাখাখাল থেকে। ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বীর উপলব্ধি হলো, বিচারটা থেমে আছে একটি নির্দেশের অপেক্ষায়। তিনি মনে করেন, ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল শামীম ওসমানের ভাই সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান মারা যাওয়ার পর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ওসমান পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছিলেন। এরপর থেকেই ত্বকী হত্যার তদন্ত কার্যত থেমে যায়।

ত্বকী হত্যার সপ্তম বার্ষিকীতে র‍্যাব–১১–এর অধিনায়ক ইমরান উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা বদলে যাওয়ায় অভিযোগপত্র দিতে দেরি হচ্ছে।

 রফিউর রাব্বী গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ত্বকী হত্যার বিচার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। তিনি চাইলে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, না হলে হবে না। ত্বকীর ঘাতকেরা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। ২০১১ সালে সিটি নির্বাচনে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া, সাংসদ শামীম ওসমানের চাঁদাবাজি, তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের ভূমি দখলের প্রতিবাদে জনগণকে সংগঠিত করায় রফিউর রাব্বির ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সাংসদ ও তাঁর অনুগতরা। তাঁকে শায়েস্তা করতেই ছেলেকে হত্যা করেন তাঁরা।

>

ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বীর উপলব্ধি হলো, বিচারটা থেমে আছে একটি নির্দেশের অপেক্ষায়।

নারয়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী মুজিব জন্মশতবর্ষে সারা দেশে আলোচিত ত্বকী হত্যার বিচার শুরু করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী এ লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে ছিল ত্বকীর। এ লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষায় রসায়নে দেশের ভেতর সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন ত্বকী। নারায়ণগঞ্জের সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে যেদিন তিনি অপহৃত হন, তার এক দিন পরই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়।

ত্বকী হত্যা মামলার সর্বশেষ অবস্থা কী, জানতে চাইলে আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, গত ২০ জানুয়ারি ত্বকী হত্যা মামলায় সুলতান শওকত ভ্রমরের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুযায়ী আসামিদের গ্রেপ্তার ও দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন জানানো হয়েছে।

এর আগে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি দেশের ২৬ বিশিষ্ট নাগরিক ত্বকীর বিচারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও হস্তক্ষেপ চেয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ত্বকী হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের আওতায়
আনা হোক।

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর লাশ উদ্ধারের এক দিন পর হত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে নজিরবিহীন হরতাল পালিত হয়। ওই দিন রাতেই ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব।

২০১৩ সালেই ত্বকী হত্যার অন্যতম আসামি ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন ও সুলতান শওকত ভ্রমর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দি অনুযায়ী, ত্বকী হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন আজমেরী ওসমান। কীভাবে তাঁকে খুন করা হবে, তা নিয়ে তিনি সুলতান শওকত, কালাম সিকদার, ইউসুফ, মামুন ও রাজীবের সঙ্গে পরামর্শ করেন। হত্যার স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ওসমান পরিবারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান উইনার ফ্যাশনকে।

আজমেরীর বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তাঁর মা পারভিন ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, আজমেরী খুন করেননি। রাজনীতি
করলে নানা কথা বলে হেয় করা হয়, এ ক্ষেত্রে     তা–ই হয়েছে। 

তবে জবানবন্দিতে সুলতান শওকত বলেন, শুধু পরিকল্পনাই নয়, ত্বকীকে খুন করার পর তাঁর লাশ বস্তায় ভরে যে গাড়িতে তোলা হয়েছিল, সেটিও ছিল আজমেরী ওসমানের। জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাব আজমেরীর টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে আলামতও সংগ্রহ করেছিল।