পলিথিন ঠেকানোর কেউ নেই

ছুটির দিন, সকাল ৯টা! সরকারি চাকরিজীবী রহমত আলীর হাতে পাঁচ পদের শাকসবজি, মাংস ও ডাল। প্রতিটি পদই পলিথিনের ব্যাগে ভরা। নিষিদ্ধ জিনিস কেন হাতে—এমন জিজ্ঞাসায় তিনি প্রথমে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। পলিথিনের দিকে ইঙ্গিত করতেই বললেন, ‘বাজারে তো পলিথিন ছাড়া অন্য কিছু নাই। কিসে নিব তাহলে?’

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শান্তিনগর বাজারে কথা হয় রহমত আলীর সঙ্গে। পলিথিনের খারাপ দিক জানেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি পলিথিন পচে না, পরিবেশের ক্ষতি করে। কিন্তু চারদিকেই তো পলিথিন আর পলিথিন। বন্ধ করার তো কোনো ব্যবস্থা দেখি না। অন্য ব্যবস্থা থাকলে সেগুলোই ব্যবহার করতাম।’

বাজারি পণ্য, চকলেটের খোসা থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির চেয়ার–টেবিল পর্যন্ত প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে দিনকে দিন। পলিথিন ও প্লাস্টিক–দূষণে সারা বিশ্বের মতো ২০ বছর ধরে বাংলাদেশও চিন্তিত। ক্ষতিকর দিকের কথা ভেবে ২০০২ সালে প্রথম পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় বিকল্প হিসেবে কাগজের ঠোঙা ব্যবহার বেড়েছিল। তবে থামেনি পলিথিনের ব্যবহার। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাজারে পলিথিন থামাতে আবারও উদ্যোগ নেয়। ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এ জন্য নামমাত্র অভিযানও পরিচালনা করা হয়। তবু অগ্রগতি হয়নি।

ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পলিথিনকে দায়ী করা হয়। অথচ পলিথিন ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এদিকে পলিথিন ও প্লাস্টিক–বর্জ্য উৎপাদনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এ তালিকায় প্রথম হয়েছে চীন, ভারত ১২তম অবস্থানে, পাকিস্তান ১৫তম ও মিয়ানমার ১৭তম অবস্থানে আছে।

দৈনিক পলিথিন

ডেনমার্কের কোপেনহেগেনভিত্তিক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টস’ বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর পাঁচ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এগুলোকে একটার পর একটা জোড়া দিলেসাতবার পৃথিবীকে ঘুরে আসবে এবং এটি ফ্রান্সের সমান আয়তনের দুটি দেশকে ঢেকে দেবে। এর মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। আর সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ এক শ বছরেও পচবে না, মাটির সঙ্গে মিশবে না। সংস্থাটির হিসাবে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই সারা বিশ্বে ৮৩ হাজার ১১২ কোটি পলিব্যাগ উৎপাদন হয়েছে।

>

ক্ষতিকর দিকের কথা ভেবে ২০০২ সালে প্রথম পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় কাগজের ঠোঙা ব্যবহার বেড়েছিল। তবে থামেনি পলিথিনের ব্যবহার।

বাংলাদেশে প্রতিদিন কী পরিমাণে পলিথিন উৎপাদন, ব্যবহার বা বর্জ্য হিসেবে জমা হয়—এ নিয়ে সরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা হিসাব নেই। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়।

বাজারে সহজলভ্য

আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও বাজারে পলিথিনের ব্যবহার চলছে দেদার। রাজধানীর রামপুরা, মালিবাগ রেলগেট, খিলগাঁও রেলগেট, বাদামতলী ঘাট ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাটজাত মোড়কের বদলে প্লাস্টিক বা পলিথিনের বস্তায় আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, সার, চাল, আদা, রসুন ও পেঁয়াজ বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে কিছু দোকানে চালের ক্ষেত্রে পাটের বস্তার ব্যবহার দেখা গেছে। বাকি পণ্যগুলোর জন্য আগের মতোই প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন অপকটে স্বীকার করলেন পলিথিন ব্যাগের ব্যবহারের কথা। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘পলিথিন পরিবেশের ক্ষতি করে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশে পলিথিন রিসাইকেল করার কোনো সিস্টেম নেই। এটি ফেলা হয় যেখানে–সেখানে। সেই সিস্টেম যদি থাকত, তাহলে আমরা দোকানিরা প্রতিটি বাজারে, দোকানের সামনে আলাদা বিনে পলিথিন জমাতাম।’

অভিযান হয়, ব্যবহার কমে না

পলিথিন দমনে বছরের পর বছর শুধু অভিযান চলে। এসব অভিযানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয় না একটুও। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত ৪ হাজার ৭৮৭টি মামলা দিয়েছেন। এসব মামলায় ৮ জনকে দণ্ড এবং ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। অভিযানগুলোতে ৮৪২ টন পলিথিন জব্দ করা হয়। এত অভিযানের পরেও পলিথিন ব্যবহার কমছে না।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করে। এরপর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দুই দফায় আদেশ দিয়ে আরও ১১টিসহ মোট ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়।

এ আদেশের আলোকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই আদেশের পর প্রথম দিকে আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাড়া পেয়েছিলাম। তবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয় না বলে এটি আগের মতো ঢিলেমি অবস্থায় চলে গেছে।’

আদালতও সরব, চাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত

এদিকে পলিথিন ও একবার ব্যবহার উপযোগী (ওয়ান টাইম) প্লাস্টিক পণ্যের দূষণ নিয়ে সরব আদালতপাড়াও। এই দুটির ব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) ১১টি সংগঠনের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ জানুয়ারি শুনানি শেষে উচ্চ আদালত এক বছরের মধ্যে দেশের উপকূলীয় এলাকায় পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার, বহন, বিক্রি ও বাজারজাতকরণ বন্ধের নির্দেশ দেন।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করল। তখন পলিথিন ব্যবহার কমে এসেছিল। তারপর আবার বাজারে পলিথিন চলে এল। বিশ্বের ৮৭টি দেশে একবার ব্যবহার উপযোগী পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। তিনি বলেন, ‘যেহেতু আইন প্রয়োগ হচ্ছে না, সে জন্যই আমরা মামলা করেছি। আমরা চাই, সরকার একটা কর্মপরিকল্পনা নিক, যেখানে হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং উপকূলীয় অঞ্চলে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়।’