নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি হাওর রক্ষা বাঁধ মেরামত

নির্ধারিত সময় চলে গেলেও নেত্রকোনার হাওরের অধিকাংশ ফসল রক্ষা বাঁধ এখনো সংস্কার করা হয়নি। গত রোববার দুপুরে খালিয়াজুরির উপজেলার রসুলপুর এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
নির্ধারিত সময় চলে গেলেও নেত্রকোনার হাওরের অধিকাংশ ফসল রক্ষা বাঁধ এখনো সংস্কার করা হয়নি। গত রোববার দুপুরে খালিয়াজুরির উপজেলার রসুলপুর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

নেত্রকোনায় হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা ছিল, কিন্তু এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নীতিমালা অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন ও ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে কাজের গড় অগ্রগতি মাত্র ৫৮ শতাংশ। এতে শঙ্কায় আছেন ওই অঞ্চলের কৃষকেরা।

জেলা পাউবো, স্থানীয় প্রশাসন ও হাওর অঞ্চলের বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেত্রকোনার ১০টি উপজেলার মধ্যে পাউবোর আওতায় হাওরভুক্ত ৭টি উপজেলায় প্রকল্পভুক্ত ৩৫০ কিলোমিটার, প্রকল্প–বহির্ভূত ৪০ কিলোমিটারসহ মোট ৩৯০ কিলোমিটার ডুবন্ত (অস্থায়ী) বাঁধ রয়েছে। বাঁধের ওপর স্থানীয় কৃষকদের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল নির্ভর করে। জেলায় এবার ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। এই ফসল রক্ষা বাঁধগুলোর মধ্যে ৯২ দশমিক ১০৯ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতের জন্য এ বছর পাউবো ১১৩টি পিআইসির মাধ্যমে ১৪ কোটি ৩০ লাখ ৮১ হাজার টাকা অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে মোহনগঞ্জে ১২টি পিআইসির জন্য ১ কোটি ৩৯ লাখ ৫৭ হাজার, খালিয়াজুরিতে ৫৪টি পিআইসির জন্য ৭ কোটি ১২ লাখ, মদনে ৩২টি পিআইসির জন্য ২ কোটি ৩৫ লাখ ৪৭ হাজার, কলমাকান্দায় ১০টি পিআইসির জন্য ১ কোটি ৫৭ লাখ ৭৪ হাজার, পূর্বধলায় ৯টি পিআইসির জন্য ১ কোটি ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে এসব প্রকল্পের কাজ শুরু করে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য পিআইসি কমিটিকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এখনো অর্ধেক কাজও সম্পন্ন হয়নি।

গত সোমবার পাউবো কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী কাজের অগ্রগতি হয়েছে মোহনগঞ্জে ৫৫ শতাংশ, খালিয়াজুরিতে ৬০ শতাংশ, মদনে ৬৪ শতাংশ, কলমাকান্দায় ৫০ শতাংশ, দুর্গাপুরে ২৫ শতাংশ, পূর্বধলায় ৬৮ শতাংশ, আটপাড়ায় ৭০ শতাংশ ও বারহাট্টায় ৬৫ শতাংশ। কাজের গড় অগ্রগতি ৫৮ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা পাউবোর কর্মকর্তাদেরই দায়ী করে আসছেন স্থানীয় কৃষকেরা। অনেক কৃষক আশঙ্কা করছেন, সময় শেষ হওয়ায় এখন হয়তো তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করে পিআইসি কমিটির লোকজন বিল তুলে নেবেন, কিন্তু এই কাজ অতটা মজবুত হবে না। ২০১৭ সালের মতো এবারও আগাম বন্যা হলে হাওরের শতভাগ ফসল হারানোরও আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।

খালিয়াজুরির চাকুয়া এলাকার ব্রজগোপাল সরকার, নিরেন্দ্র দাস, অসিত সরকার বলেন, ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খালিয়াজুরিতে মোট ৯ বার বন্যার পানিতে বাঁধ ভেঙে ফসল নষ্ট হয়। বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় এবার আগাম বন্যা হলে বোরো ফসল হুমকির মুখে পড়বে। তাঁরা বলেন, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ ও মদন উপজেলা মূলত হাওর এলাকা। জেলায় ছোট–বড় মোট ১৩৪টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে খালিয়াজুরিতে ৮৯টি হাওর রয়েছে। বোরো ফসলই এখানকার একমাত্র ফসল।

হাওরে একসময় ঠিকাদারদের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হতো। পরে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তা বাতিল করে বাঁধের কাজে পিআইসির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষক ও সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে। ২০১৭ সালের বন্যায় হাওরে ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও হয়। বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা করে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে সরাসরি যুক্ত করা হয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উপজেলা কমিটির সভাপতি, পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী সদস্যসচিব এবং জেলা প্রশাসক জেলা কমিটির সভাপতি ও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সদস্যসচিব।

মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খালিয়াজুরির চাকুয়া ও ফেনারবাগ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামতের কাজের এফডিসি প্রকল্প পোল্ডার-১–এ দেখা গেছে, ওই প্রকল্পের অধীনে ছয়টি পিআইসির মধ্যে মাত্র দুটির কাজ প্রায় ৭৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ওই দুটি পিআইসির সভাপতি দেবরাজ মহাপাত্র ও শোভা রানী বলেন, তাঁরা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে সক্ষম হবেন, কিন্তু বাকি চারটি প্রকল্পের কাজ মাত্র ২০ থেকে ৪০ শতাংশ সম্পন্ন  হয়েছে। ওই পিআইসিগুলোর সভাপতি নুরুল হুদা চৌধুরী, যতীন্দ্র মহানবিশ, আতাউর রহমান ও মিল্টন সরকার বলেন, কাজ শেষ করতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।

জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিছুর রহমান বলেন, ‘সব প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় আমরা হতাশ।’

জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘হাওরে পানি দেরিতে নামায় কাজ শুরু করতে একটু দেরি হয়েছিল, তাই শেষ করতে আরও ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে।’

জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম বলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কাজ শেষ না হলে পিআইসির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’