পানির নিচেও বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ছিল রোশনি

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখা বাবা শামীমের হাত দুটি তখনো বুকের ওপর সেভাবেই শক্ত হয়ে ছিল। পাশে শামীমের স্বজনের আহাজারি। ছবি: শহীদুল ইসলাম
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখা বাবা শামীমের হাত দুটি তখনো বুকের ওপর সেভাবেই শক্ত হয়ে ছিল। পাশে শামীমের স্বজনের আহাজারি। ছবি: শহীদুল ইসলাম

সাত বছরের রোশনি বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ছিল। হয়তো বাঁচার জন্যই বাবাকে জড়িয়ে ধরে ছিল অথবা নৌকায় বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কোলেই বসা ছিল। আজ শনিবার উদ্ধারকারী দল পানির নিচ থেকে গলা জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায় বাবা শামীম ও মেয়ে রোশনির লাশ উদ্ধার করে।

বিয়ের পর বউভাতের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে পদ্মা নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ছয়টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। যাঁদের লাশ উদ্ধার হয়েছে, তাঁরা হলেন কনের বড় বোন শাহীনুর বেগমের স্বামী রতন আলী (৩০), তাঁদের মেয়ে মরিয়ম খাতুন (৮), চাচা শামীম (৩৫), চাচি মিনরা বেগম (২৮), চাচাতো বোন রোশনি (৭) ও খালাতো ভাই এখলাস হোসেন (২২)।

এই দুর্ঘটনায় বর বেঁচে গেছেন। তবে আজ শনিবার রাত ৯টা পর্যন্ত কনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শুধু কনে নন, তাঁর ফুপাতো বোন রুবাইয়া খাতুন (১২) ও খালা আঁখি খাতুন (২৫) নিখোঁজ।

কনে সুইটি খাতুনের বাবা শাহীন আলী একজন ট্রাকশ্রমিক। বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার ডাঙ্গেরহাট গ্রামে। বর রুমন আলী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয়। তাঁর বাড়ি উপজেলার চরখিদিরপুর গ্রামে। গ্রামটি পদ্মা নদীর ওপারে। গতকাল শুক্রবার বরের বাড়িতে বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে নৌকাডুবির এ ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আজ সকালে উপজেলার বসুয়া গ্রামে মরিয়মকে দাফনের পর বাবা রতনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁকেও মেয়ের কবরের পাশেই দাফন করা হয়।

আর ডাঙ্গেরহাট গ্রামে কনে সুইটির বাড়ির পাশে পরপর চারটি কবর খোঁড়া হচ্ছে। এগুলোতে কনের চাচা, চাচি ও চাচাতো বোনকে দাফন করা হবে। আর একটি কবর সুইটির জন্য। কবর খুঁড়ছিলেন প্রতিবেশী সাদ্দাক আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা নিখোঁজ আছেন, তাঁরা আর কেউ বেঁচে থাকতে পারেন না। তবে তাঁদের লাশ পাওয়া যাবে, এই আশায় পাশাপাশি চারটি কবর খুঁড়ছেন। পাশের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটা হচ্ছে। একদল লোক বাঁশ চিরে বাতা তৈরি করছেন। আরেক দল কবর খুঁড়ছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য যে সাউন্ডবক্স নিয়ে আসা হয়েছিল, সেগুলো এখনো সুইটিদের বাড়ির এক কোনায় পড়ে রয়েছে। পাশের বারান্দায় বসে তাঁর মা বিলাপ করছেন। বলছেন, ‘আমি একা কয়জনের বাড়ি যাব, কয়জনের শোক সামাল দিব। এখুনি নাতিকে মাটি দিয়ে এলাম, আবার জামাইকে মাটি দিতে যাব।’ একপর্যায়ে আর কথা বলতে পারছেন না তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়েন।

পদ্মা নদীর শ্রীরামপুর এলাকায় নিখোঁজদের স্বজনদের সঙ্গে হাজারো মানুষ সারা দিন অপেক্ষায় ছিল। ছবি: প্রথম আলো
পদ্মা নদীর শ্রীরামপুর এলাকায় নিখোঁজদের স্বজনদের সঙ্গে হাজারো মানুষ সারা দিন অপেক্ষায় ছিল। ছবি: প্রথম আলো



গ্রামে এক দৃশ্য পদ্মা নদীর ধারে আরেক দৃশ্য। পদ্মা নদীর শ্রীরামপুর এলাকার স্বজনদের সঙ্গে হাজারো উৎসুক মানুষকে সারা দিন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে যখন বাবা-মেয়ের লাশ পাওয়া গেল তখন আর কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। রাজশাহী সদর ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন অফিসার আবদুর রউফ বাবা-মেয়েকে একসঙ্গে পাওয়ার বর্ণনা দিতেই গিয়ে বলেন, সন্তানের প্রতি বাবার যে ভালোবাসা কত, তা এই জোড়া লাশ দেখেই বোঝা যায়। মেয়েকে বাঁচাতে গিয়েই বাবা হয়তো নিজে বাঁচতে পারেননি।

যেভাবে কনে ডুবে গেলেন

কনে সুইটি খাতুনের সঙ্গে একই নৌকায় ছিলেন তাঁর আত্মীয় টুলু বেগম (৩০)। তিনি গায়ের শাড়ি খুলে ফেলে একটি চরাট ধরে ভাসছিলেন। এ সময় তিনি দেখেন সুইটি হাবুডুবু খাচ্ছেন। তার কপালের টিকলি দেখে তিনি তাঁকে চিনতে পারেন। বাঁচার জন্য তিনি সুইটিকে তাঁর কাপড় খুলে ফেলতে বলেন। সুইটি কাপড় খোলার চেষ্টা করতে যাচ্ছিলেন। পরক্ষণেই তাকিয়ে দেখেন সুইটি আর নেই। টুলু বেগমের স্বামী আবদুর রাজ্জাকও নৌকায় ছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী ছোট নৌকায় যাত্রী বেশি ছিল। ঢেউয়ে নৌকায় পানি উঠে যাচ্ছিল। তাঁরা কয়েকজন পুরুষ যাত্রী পানিতে নেমে নৌকা জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করেও পারেননি।

তদন্ত কমিটির সদস্য পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহাদাত হোসেনও নৌকা ডোবার কারণ হিসেবে একই কথা বলেন, ছোট নৌকায় যাত্রী বেশি ছিল, বাতাস উঠেছিল নদীতে। ঢেউ ছিল। এই অবস্থায় কিছু যাত্রী এক নৌকা থেকে লাফিয়ে আরেক নৌকায় যাওয়ার সময় দোল খেয়ে নৌকা ডুবে যায়।

উদ্ধারের জন্য একসঙ্গে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও রাজশাহী মহানগর নৌ পুলিশ।

নৌকাডুবির ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলামকে আহ্বায়ক করে গতকাল জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের এই কমিটি করে দিয়েছে। দুই কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে বলা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক হামিদুল হক জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এখন নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে মরদেহ দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা হচ্ছে।