তিনি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ রেকর্ড করেছিলেন

ঢাকার পূর্ব বাড্ডার এক ঘিঞ্জি গলির শেষ মাথায় থাকা সৈয়দ মইনুল আহসানের বাড়িটি খুঁজে পেতে কিছুটা বেগ পেতে হয়। আবর্জনায় সয়লাব সরু রাস্তা পেরিয়ে তাঁর বিবর্ণ বাড়িটিতে যখন পৌঁছাই, তখন জুমা নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। গত শুক্রবার তাঁর বাড়িতে বসেই তাঁর সঙ্গে কথা হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণটির শব্দ ধারণ করার দায়িত্ব পড়েছিল মইনুল আহসানের ওপরই।

ভাষণটি তৎকালীন সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ক্যামেরায় ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মহিবুর রহমান খানের (প্রখ্যাত অভিনেতা আবুল খায়ের) নির্দেশে ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন, ক্যামেরাম্যান এম এ রউফ, ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, ক্যামেরা সহকারী এস এম তৌহিদ, ক্যামেরা সহকারী সৈয়দ মইনুল আহসানসহ আরও দুই লাইটবয় সেসময়ের রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছান। ভাষণ ধারণ করতে দুটি ক্যামেরা ব্যবহৃত হয়। মূল ভাষণ রেকর্ড করতে একটি এবং অন্যান্য ফুটেজ নিতে আরেকটি ক্যামেরা কাজ করে। মূল ভাষণের শব্দ রেকর্ড করার কাজে ছিলেন সৈয়দ মইনুল।

সৈয়দ মইনুল আহসান। পূর্ব বাড্ডা, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: আবদুস সালাম
সৈয়দ মইনুল আহসান। পূর্ব বাড্ডা, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: আবদুস সালাম

এখন বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছেন মইনুল। কথা বলতে ও শুনতে তাঁর অসুবিধা হয়। তবু সাতই মার্চের ভাষণের প্রসঙ্গ উঠতেই সত্তোরর্ধ্বের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলতে শুরু করেন, ‘১৯৬৯ সালে আমি ক্যামেরা অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে ডিএফপিতে যোগ দিই। ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভয়েস রেকর্ড করার দায়িত্বে। মঞ্চের কাছে দুটো নাগরা (শব্দ ধারণ যন্ত্র) স্থাপন করা হয়। যাতে বঙ্গবন্ধুর একটি কথাও বাদ না পড়ে। তবে একটিই যন্ত্রতেই পুরো ভাষণ রেকর্ড হয়ে যায়। অন্যটি চালানোর দরকার হয়নি।’

স্মৃতিকাতর হন মইনুল হোসেন। বলে যান তিনি , ‘পুরো ভাষণ জুড়ে আমি মঞ্চের খুব কাছে ছিলাম। রেসকোর্স ময়দানের সেদিকে তাকাই সেদিকেই মানুষ আর মানুষ। পুরো মাঠ মানুষে ভরে গেলো। মাঝখানে ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ভাষণের মধ্যেই তার প্রতিবাদ জানান। পরে অবশ্য আবার সম্প্রচার করা হয়।’

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৈয়দ মইনুল আহসানসহ (লাল বৃত্তে) অন্যান্যরা। ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৈয়দ মইনুল আহসানসহ (লাল বৃত্তে) অন্যান্যরা। ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দ মইনুল জানালেন, ভাষণ শেষে শব্দ ধারণ যন্ত্র ও ভিডিও ক্যামেরা খুব সবাধানে সচিবালয়ের ফটক দিয়ে বের করা হয়। বের হওয়ার সময় এক পাকিস্তানি সেনা তাঁদেরকে ধরেন। সৈয়দ মইনুল বললেন, ‘ভয়ে তখন গায়ের পশর দাঁড়িয়ে গেল। এখন কী হবে!। ওই পাকিস্তানি সেনা জানতে চাইল, আমাদের সঙ্গে এসব কী? আমরা বললাম তেমন কিছু না এবং তাঁকে আমরা আমাদের পাস দেখালাম। তখন ওই পাকিস্তানি সেনা আর কিছু বলল না, যেতে দিল।’ সেখান থেকে আমরা অফিসে চলে আসি।’

২৫ মার্চ রাতে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তখন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। রেকর্ডগুলো ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে দায়িত্ব দেওয়া হয় আমজাদ আলী খন্দকারকে। তিনি ঢাকার দোহারের এক বাড়িতে সেগুলো লুকিয়ে রাখেন। মইনুল বলেন, ‘রেকর্ডগুলো একটি বাক্সে ছিল। সেই বাক্স মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। তারপর বরযাত্রীর কথা বলে একটি নৌকা বা লঞ্চ সাজানো হয়। সেই লঞ্চে করে রেকর্ডগুলো আগরতলায় পৌঁছে দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সেগুলো আবার ফিরিয়ে আনা হয়।’

এই ক্যামেরা ও শব্দ ধারণ যন্ত্র দিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ করা হয়েছিল। ছবি: ডিএফপির সৌজন্যে
এই ক্যামেরা ও শব্দ ধারণ যন্ত্র দিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ করা হয়েছিল। ছবি: ডিএফপির সৌজন্যে

তিনি জানালেন, সাতই মার্চের আগেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর একাধিকবার দেখা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) আমাকে চিনতেন। বঙ্গবন্ধুর একটি আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। তাঁর প্রখর স্মরণশক্তি। যাকে একবার দেখতেন, পরে মুহূর্তে তাকে মনে করতে পারতেন। তাঁর বাড়িতে সব সময় যেতাম। শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিয়েতেও গিয়েছি। বঙ্গমাতা অন্য ধরনের মানুষ ছিলেন। এত মানুষ বাড়িতে আসা–যাওয়া করছেন—দিন নেই, রাত নেই।’

কিছুটা কষ্ট নিয়েই তিনি বললেন, ‘সাতই মার্চের ঘটনা এখনো নতুন মনে হয়। এই ঘটনা পুরোনো হতে পারে না। আমরা যতজন বেঁচে আছি, এই ঘটনা নিয়েই বেঁচে আছি। কিন্তু জাতির কাছ থেকে আমরা তো কিছু পেলাম না। সরকার কতজনকে কত কিছু করে দিল। অনেকে প্লট পেল, বাড়ি পেল। আমাদের কেউ খোঁজও নিল না।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন সৈয়দ মইনুল। পূর্ব বাড্ডা, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: আবদুস সালাম
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন সৈয়দ মইনুল। পূর্ব বাড্ডা, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: আবদুস সালাম

১৯৭৫–এর ১৫ আগস্টের কথাও তুললেন সৈয়দ মইনুল আহসান। তিনি জানালেন, সকালে রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘোষণাটি শুনে তিনি ভীষণ মর্মাহত হন। বঙ্গবন্ধু আর নেই শুনে তিনি সেদিন নীরবে বসে কেঁদেছেন বলেও জানান। এখনো সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগ–আপ্লুত হয়ে পড়েন সৈয়দ মইনুল।

সৈয়দ মইনুল আহসানের জন্ম ১৯৪৮ সালে, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে। অসুস্থতার কারণে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৮৩ সালে সৈয়দা নূরজাহান বেগমকে বিয়ে করেন। ২০০৬ সালে ফিল্ম প্রোডিউসার থাকা অবস্থায় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে সৈয়দা ফাতেমা জোহরা পড়াশোনা শেষে এখন গৃহিনী। ছেলে সৈয়দ আল আযিযুল আহসান এমবিএ এবং ছোট মেয়ে সৈয়দা খাদিজা কোবরা মাস্টার্স করছেন। পূর্ব বাড্ডার বাড়িটি তাঁর নিজের। বাড়ি ভাড়া দিয়েই সংসারের ব্যয় মেটে।