শ্রমজীবী নারীদের মজুরি এখনো কম

পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি কম নারী শ্রমিকদের। সম্প্রতি পঞ্চগড় সদর উপজেলার একটি চা–বাগানে।  ছবি: প্রথম আলো
পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি কম নারী শ্রমিকদের। সম্প্রতি পঞ্চগড় সদর উপজেলার একটি চা–বাগানে। ছবি: প্রথম আলো

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ রোববার। এই দিবস উপলক্ষে নারীর অধিকার, মজুরিসহ নানা বিষয়ে সম–অধিকার নিয়ে অনেক সভা–সেমিনার হয়; কিন্তু গাইবান্ধা, পঞ্চগড়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মজুরি–বৈষম্য কমেনি। তাঁরা পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করেন, কিন্তু তাঁদের অর্ধেক মজুরি দেওয়া হচ্ছে। মজুরির বিষয়ে প্রতিবাদ করেও তাঁরা কোনো ফল পান না।

 নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মজুরি–বৈষম্যের এ চিত্র পাওয়া গেছে। একসময় নারীরা ঝিয়ের কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন। এখন তাঁরা মাঠে-ঘাটে কাজ করেন। অনেকে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন, বিশেষত নারী শ্রমিকেরা বোরো ফসলের পরিচর্যা, ধানের চারা রোপণ, ধান ও মাটি কাটা এবং ইটভাটায় কাজ করে থাকেন। সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করলে এক দিনের কাজ ধরা হয়। স্থানীয়ভাবে এক দিনের পুরুষ শ্রমিকের মজুরি ৪০০ টাকা। এ হিসাবে একজন নারী শ্রমিকেরও ৪০০ টাকার পাওয়ার কথা, কিন্তু তাঁরা সমান কাজ করেও পান ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি গ্রামের শ্রমিক ফাতেমা বেগম (৪৫) বলেন, ‘সকাল ৯টা বাজলেই আমরা কৃষিজমিতে কাজ করতে যাই। তেমনি একজন পুরুষ শ্রমিকও কাজে যায়। কাজ থেকে ফিরে আসি একই সময়ে, কিন্তু পুরুষেরা দৈনিক মজুরি ৪০০ টাকা পেলে আমরা পাই ২৫০ টাকা।’

একই গ্রামের নারী শ্রমিক জোহরা খাতুন (৪০) বলেন, ‘তিন বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছেন। দুই সন্তান নিয়ে সংসার চলে না। তাই শ্রমিকের কাজ করি। কখনো বোরো ধানের জমিতে, কখনো ইটভাটায় কাজ করি। নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি সময় ধরে কাজ করে। কাজের মধ্যে পুরুষেরা বিশ্রামের বিরতি নিলেও নারীরা তেমন বিশ্রাম নেয় না, কিন্তু পুরুষেরা ৪০০ টাকা মজুরি পেলে আমরা পাই অর্ধেক টাকা।’

সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের নারী শ্রমিক কবিরন নেছা (৩৫) বলেন, ‘আমি ইটভাটায় কাজ করি। ইট বহন কষ্টকর কাজ। তারপরও পুরুষের সমান মজুরি পাই না। পুরুষ শ্রমিক দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা পায়, আমরা পাই ৩০০ টাকা। সমান টাকা চাইলে কাজ থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।’ ওই গ্রামের পুরুষ শ্রমিক বাবলু মিয়া বলেন, ‘আমরা চাই নারীরা আমাদের সমান মজুরি পাক, কিন্তু মালিকেরা দিতে চান না। ’

মজুরি–বৈষম্য প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাইবান্ধা সদর উপজেলার একজন ইটভাটার মালিক বলেন, ‘আমি মজুরি কম দিই না। সব ভাটামালিক যা দেন, আমিও তা–ই দিচ্ছি।’  

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গাইবান্ধা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রিকতু প্রসাদ বলেন, ‘নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় পুরুষ শ্রমিকেরা মাটি কেটে দেন, সেই মাটি বহন করেন একজন নারী শ্রমিক। কী মর্মান্তিক। তারপরও নারী শ্রমিকেরা বেশি মজুরি–বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। মজুরি–বৈষম্য দূর করতে সামাজিক আন্দোলন দরকার। এ নিয়ে আমরা অসংখ্য উঠান বৈঠক করেছি। মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছি, প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছি।’

 পঞ্চগড়েও নারী শ্রমিকদের পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি দেওয়া হচ্ছে। পাথর ভাঙা, প্রক্রিয়াকরণ, সমতল ভূমিতে চাষ করা, চায়ের পরিচর্যা, চা–পাতা সংগ্রহ, চা–কারখানা, ভবন নির্মাণ ও কৃষিকাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই জেলায় প্রায় ১০ হাজার নারী শ্রমিক দিন-রাত পরিশ্রম করছেন।

পঞ্চগড় জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিনই পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে কাজে অংশ নিচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা। তবে তাঁদের কম মজুরি দেওয়া হয়। জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এলাকায় একেকজন পুরুষ পাথরশ্রমিক পাথর ভাঙা মেশিনে কাজ করে প্রতিদিন (আট ঘণ্টা) ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন, কিন্তু নারী শ্রমিকেরা পাচ্ছেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।

 জেলার সদর, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন চা–বাগান ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বাগান থেকে কাঁচা চা–পাতা সংগ্রহ করতে আট ঘণ্টা কাজ করে একজন নারী শ্রমিক পাচ্ছেন মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর পুরুষ শ্রমিকেরা পাচ্ছেন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। বোরো ধান রোপণ, মরিচ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন খেত নিড়ানিসহ অন্যান্য কৃষিকাজে পুরুষ শ্রমিকেরা সারা দিন কাজ করে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পেলেও একই কাজ করে নারী শ্রমিকেরা পাচ্ছেন ২০০ টাকা।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এলাকার পাথর ভাঙা শ্রমিক রেহানা বেগম বলেন, ‘আমি ৪ থেকে ৫ বছর ধরে পাথর ভাঙার কাজ করছি। এর আগে সবারই মজুরি কম ছিল, তখনো আমাদের নারী–পুরুষের মধ্যে মজুরি পার্থক্য ছিল। এখন মজুরি কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু আমরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেও মজুরি কম পাচ্ছি।’

সদর উপজেলার একটি চা–বাগানের নারী শ্রমিক মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘চায়ের মৌসুম শুরু হলেও এখনো পুরো দমে পাতা সংগ্রহ শুরু হয়নি। বর্তমানে আমরা দৈনিক হাজিরা হিসেবে চা–পাতা সংগ্রহ করছি। এরপর কেজিতে চুক্তি হিসেবে পাতা তুলব। বর্তমানে প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করে আমরা ২০০ টাকা পাই। আর পুরুষেরা আমাদের সঙ্গেই কাজ করে পায় ৩০০ টাকা। সমান কাজ করলেও আমাদের মজুরি কম।

কৃষিশ্রমিক পেয়ারা বেগম বলেন, ‘আমরা ভুট্টাখেতে নিড়ানি দেওয়ার কাজ করছি। সারা দিন সমান কাজ করেও আমাদের মজুরি ২০০ টাকা আর পুরুষদের মজুরি ৩০০ টাকা।’

এ বিষয়ে পঞ্চগড়ের নারী উন্নয়ন কর্মী ও স্থানীয় এনজিও পরস্পরের নির্বাহী পরিচালক আকতারুন নাহার বলেন, ‘সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, পদায়ন হয়েছে, নারী–পুরুষ সমন্বয়ে কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রান্তিক পর্যায়ে এই বাস্তবতা ভিন্ন। নারীরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন, তাঁরা কাজে ফাঁকি দেন না। সে জন্যই অনেকে ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীদের শ্রমিক হিসেবে নিতে অনেকেই আগ্রহী হন, কিন্তু মজুরি দেওয়ার সময় তাঁদের (নারীদের) বৈষম্যের শিকার হতে হয়। আমরা চাই, এই ধরনের মানসিকতা থেকে সমাজ মুক্তি পাক। সমাজে নারী ও পুরুষের মজুরি–বৈষম্য দূর হয়ে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হোক।’