পাখির জন্য ভালোবাসা

পাবনার বেড়া উপজেলার কাজী শরিফপুর গ্রামে বক ও পানকৌড়ির অবাধ ওড়াউড়ি। গ্রামের রফিকুল ইসলামের বাড়ির উঠান থেকে সম্প্রতি ছবিটি তোলা ষ প্রথম আলো
পাবনার বেড়া উপজেলার কাজী শরিফপুর গ্রামে বক ও পানকৌড়ির অবাধ ওড়াউড়ি। গ্রামের রফিকুল ইসলামের বাড়ির উঠান থেকে সম্প্রতি ছবিটি তোলা ষ প্রথম আলো

বছর চারেক আগের কথা। আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ। হঠাৎ একঝাঁক সাদা বক উড়ে এসে বসে এক বাড়িতে। বাসা বাঁধে, বাচ্চা ফোটায়। বাড়ির মালিক বক ও তাদের ছানাগুলোকে মাঝে মাঝে খেতে দেন। ছানাগুলো বাসা থেকে পড়ে গেলে তুলে দেন বাসায়। পাখিগুলো মালিকের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়। ছানাগুলো বড় হয়ে উঠলে পাখিগুলো চলে যায়।
পরের আষাঢ়ে আবার ওদের দেখা মেলে। কিন্তু সংখ্যাটা আগের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। সে বছর বাড়িটির প্রায় সবগুলো গাছে বাসা বাঁধে। বাড়ির মালিক আবারও ভালোবাসা দিয়ে মুগ্ধ করেন ওদের। শিকারির হাত থেকে রক্ষা করতে বসান পাহারা।
তৃতীয় বছরে একই ঘটনা ঘটে। তবে এবার শুধু বক নয়, সাদা বকের সঙ্গে দেখা যায় কালো পানকৌড়ি। এক বাড়ি থেকে দুই বাড়ি, তিন বাড়ি বাসা বাঁধে। এর পর থেকে সংখ্যাটা শুধু বাড়ছেই।
এই আষাঢ়ে আবার এসেছে ওরা। তবে এবার সংখ্যাটা অবাক করার মতো। তিন বাড়ি থেকে ছড়িয়ে গ্রামের প্রায় ১০টি বাড়ির শতাধিক গাছে বাসা বেঁধেছে। শত শত বক আর পানকৌড়ি ছানার কলকাকলিতে মুখর পুরো গ্রাম। সাদা আর কালো রঙের পাখিতে ঢেকে আছে গাছের ডালপালা। পাখির বিষ্ঠায় সাদা হয়ে আছে বাড়ির চাল ও উঠান। সকাল হলে খাবারের সন্ধানে ছুটছে ওরা। সন্ধ্যা হলে ফিরে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে। পাখির ঝাঁক দেখতে দূূর-দূরান্ত থেকে আসছেন বহু পাখিপ্রেমী মানুষ।
গ্রামবাসীর ভালোবাসায় পাখির এই অভয়ারণ্য সৃষ্টি হয়েছে পাবনার বেড়া উপজেলার মাসুমদিয়া ইউনিয়নের কাজী শরিফপুর গ্রামে। সার্বক্ষণিক পাখিগুলোর দিকে নজর রাখছেন গ্রামের রফিকুল ইসলাম মৃধা ও আবদুল আলেক মৃধা। তাঁদের বাড়ি থেকেই প্রথম শুরু হয়েছিল পাখিগুলোর আতিথেয়তা।
কথা হয় রফিকুলের সঙ্গে। তিনি জানান, পদ্মা ও যমুনা নদীর মিলনস্থলে কাজী শরিফপুর গ্রাম। গ্রামের আশপাশে রয়েছে ছোট ছোট কয়েকটি বিল। আষাঢ় মাসের শুরুতে নদী ও বিলে বর্ষার পানি আসতে শুরু করলেই বক আর পানকৌড়িগুলো আসতে শুরু করে। গাছে গাছে বাসা বাঁধে, ডিম দেয়, বাচ্চা ফোটায়। নদী ও বিল থেকে খাবার সংগ্রহ করে। এরপর বাচ্চাগুলো বড় হয়ে উঠলে অন্যত্র চলে যায়। ছয় মাসের মতো পাখিগুলো এখানে থাকে বলে জানালেন তিনি।
রফিকুলের ভাষায়, ‘পাখিগুলো ভালোবাসা বোঝে। তাই ফিরে আসে বারবার। আমরাও ওদের ভালোবাসায় মুগ্ধ। বিষ্ঠা/মল ও উচ্ছিষ্ট খাবারে বাড়িঘর নষ্ট হয়ে যায়। দুর্গন্ধে মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। তবুও পাখিগুলোর জন্য মায়া লাগে। তাই অবহেলা করি না। শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা করতে রাত-দিন পাহারা দিয়ে রাখি।’
সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে কথা হয় পাখি দেখতে আসা অনেকের সঙ্গে। সুলতানা, পিয়াল, বৃষ্টি, পলাশ, প্রীতি ও ঊর্মি পাশের গ্রাম থেকে এসেছেন। সময় পেলেই ছুটে আসেন তাঁরা। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আর পাখির কলকাকলি তাঁদের মুগ্ধ করে।
কথা হলো স্থানীয় দিয়ার ব্রামুন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমানের সঙ্গে। তিনিও পাখিপ্রেমী। সময় পেলেই ছুটে আসেন এখানে। তাই নানা সমস্যা সত্ত্বেও পাখিগুলোকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এ গ্রামের মানুষের মতো সবাইকে পাখির প্রতি ভালোবাসা বাড়ানোর আহ্বান জানান।