সবাইকে একইভাবে বিচার প্রদানই সাংবিধানিক দায়িত্ব

বিচারপতি জিনাত আরা। ছবি: প্রথম আলো
বিচারপতি জিনাত আরা। ছবি: প্রথম আলো

‘বিশেষ কোনো বিজ্ঞ আইনজীবী দাঁড়ালেন, কোন রাজনৈতিক ব্যক্তির মামলা, কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির মামলা এসব বিবেচনা না করে সবাইকে একইভাবে বিচার প্রদান করাই আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সংবিধানে বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে জনগণের জন্য করার কথা বলা হয়েছে।’

কথাগুলো বললেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি জিনাত আরা। আপিল বিভাগের ১ নম্বর বিচারকক্ষে (প্রধান বিচারপতির এজলাস) আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে এক বিদায়ী সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন। আইনজীবী ও আগত বক্তিদের উপস্থিতিতে আদালত  কক্ষ ছিল পূর্ণ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিরা এ সময় বেঞ্চে ছিলেন।

জিনাত আরা আপিল বিভাগে নিয়োগ পাওয়া দ্বিতীয় নারী বিচারপতি।

১৯৫৩ সালের ১৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করা আপিল বিভাগের এই বিচারপতির ৬৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে ১৪ মার্চ। তবে সেদিন ছুটি থাকায় আজ ছিল শেষ কর্মদিবস। যার মধ্য দিয়ে এই বিচারপতির ৪১ বছরের বেশি সময়কালের বিচারিক কর্মজীবনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে।

প্রথা অনুসারে বৃহস্পতিবার এই বিচারপতিকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। সংবর্ধনায় প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বিদায়ী বিচারপতি জিনাত আরার কর্মময় জীবন নিয়ে বক্তব্য দেন।

নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বিচারপতি জিনাত আরা বলেন, ‘আমি ঢাকা কোর্টে নারী মুনসেফ হিসেবে প্রথম যোগ দিই। আমার পূর্বে ঢাকায় কোনো নারী বিচারক না থাকায় আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। শত শত লোক প্রতিদিন কোর্টে আমাকে দেখতে আসত। পুরান ঢাকায় কেউ এলে সুযোগ পেলেই কোর্টে আমাকে একনজর দেখতে যেত। এমন পরিস্থিতিতে বিচারকার্য সঠিকভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে কোর্টে মানুষের ভিড় কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল।’

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব বিচারক ও আইনজীবীদের ওপর সমানভাবে বর্তায় বলে মনে করেন বিচারপতি জিনাত আরা। আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আইনজীবীদের সার্বিক সহযোগিতা ব্যতীত বিচারকার্য সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। দেশের সুপ্রিম কোর্টসহ সব অধস্তন আদালতের বিচারকদের স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করার নেপথ্যে আইনজীবীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আপনাদেরই পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে। দলমত–নির্বিশেষে বিচারপ্রার্থী জনগণকে সহায়তা করতে হবে। আশা করব, আপনারা দলমত-নির্বিশেষে বিচারপ্রার্থী জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন। বিচার বিভাগের প্রতি যেন জনগণের আস্থার সংকট না হয়, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি যেন সমুজ্জ্বল থাকে, আইনজীবীরা সে ব্যাপারে সব সময় সজাগ থাকবেন। মনে রাখবেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করার মূল দায়িত্ব আমাদেরই।’

বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিচারপতি জিনাত আরা ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসেবে বিচার বিভাগে যোগ দেন। এরপর ১৯৯৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পদোন্নতি পেয়ে জেলা ও দায়রা জজ হন। ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।

প্রসঙ্গত, এর আগে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, যিনি দেশের ইতিহাসে আপিল বিভাগে নিয়োগ পাওয়া প্রথম বিচারপতি। ৪২ বছরের বিচারিক কর্মজীবন শেষে ২০১৭ সালের ৭ জুলাই বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অবসরে যান। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথম নারী বিচারক, যিনি ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসেবে বিচার বিভাগে যোগ দেন। নাজমুন আরা সুলতানা ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজ হিসেবে যোগ দেন, যা ছিল প্রথম কোনো নারীর জেলা জজ হওয়া। পরে ২০০০ সালের ২৮ মে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হন তিনি এবং এর দুই বছর পর তিনি হাইকোর্টে স্থায়ী হন, এটিও ছিল প্রথম।