বরিশাল বিভাগে ৬২৯ কিমি ডুবোচরে বিপন্ন ৪২ নদ-নদী

দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে চলাচল করা নৌযান প্রায়ই ডুবচরে আটকে যায়। ফাইল ছবি
দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে চলাচল করা নৌযান প্রায়ই ডুবচরে আটকে যায়। ফাইল ছবি

বরিশাল বিভাগের ৪২টি নদ-নদীর ৬২৯ কিলোমিটার এলাকায় ডুবোচরের কারণে নদীগুলো স্বাভাবিক চরিত্র হারাচ্ছে। এতে নৌপথ সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে ঝুঁকি। একই সঙ্গে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদেরা।

এদিকে আজ ১৪ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল ডে অব অ্যাকশন ফর রিভারস বা আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। দিনটি সামনে রেখে দক্ষিণাঞ্চলে নদীরক্ষা কার্যক্রমের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, ২০১৮ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এসব নদীর নাব্যতা ফেরাতে সমীক্ষা করে একটি প্রকল্প তৈরির উদ্যোগ নিলেও পরে সেই প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। ফলে এসব নদীর অস্তিত্ব ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে।

গত ফেব্রুয়ারির শেষে এ বিষয়ে কথা হয় পাউবোর বরিশাল অঞ্চলের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রমজান আলী প্রামাণিকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব নদীর নাব্যতা সুরক্ষার জন্য ২০১৮ সালে আমরা সমীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ জন্য লোকবলও নিয়োগ করা হয়েছিল। পরে আমি বদলি হয়ে আসার পর এর অগ্রগতি সম্পর্কে জানি না।’

পাউবো সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে এসব নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় সে কাজ আর এগোয়নি। বরিশাল বিভাগের ৪২টি নদ-নদী এখন পলি জমে অস্তিত্ব হুমকিতে পড়েছে। এসব নদী চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ৪২টি নদ-নদীর বিভিন্ন অংশের ৬২৯ কিলোমিটার খনন করা প্রয়োজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জুলফিকার আলী হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সার্ভে করে কীভাবে এসব নদীর নাব্যতা ফেরানো যায়, সে বিষয়ে একটি নকশা (ডিজাইন) তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে এ-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়নি। তবে এখন আমরা যেসব এলাকায় ভাঙন রয়েছে, সেসব এলাকায় নাব্যতা সংকট থাকলে তা খনন করছি।’

বিপন্ন নৌ যোগাযোগ

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার বুড়াগৌরাঙ্গ, দাড়ছিঁড়া, রামনাবাদ, আগুনমুখা, ডিগ্রিসহ সব নদ-নদী ও মোহনায় সৃষ্ট অসংখ্য ডুবোচরের কারণে ব্যাহত হচ্ছে নৌ যোগাযোগ। প্রমত্তা ডিগ্রি নদীর মাঝখানে বিশাল ডুবোচর জেগে ওঠায় গলাচিপা-রাঙ্গাবালী নৌ চলাচল হুমকিতে পড়েছে। শুধু জোয়ারের সময় চলাচল করতে পারলেও ভাটার সময় এই পথে লঞ্চ-ট্রলার কিছুই চলাচল করতে পারে না। গত কয়েক বছরে বুড়াগৌরাঙ্গ নদের চর কাজলসংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে।

পিরোজপুরের কচা নদী, বলেশ্বর নদের অবস্থা আরও বেহাল। বলেশ্বর নদের বিশাল অংশ এখন মৃত। যতটুকু অস্তিত্ব আছে, তাও ডুবোচর পড়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নৌযানসহ ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

কচা নদীতে জেগে ওঠা বিশাল চরের কারণে টগড়া-চরখালী ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। পানি কমে যাওয়ায় প্রতিদিন ভাটার সময় ফেরিঘাটের টগড়া প্রান্তে ফেরি চরে আটকে যাওয়ায় যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। একাধিক ডুবোচর থাকায় দেশি-বিদেশি নৌযান চলাচল এখন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ভাটার সময় দেশি-বিদেশি বড় জাহাজ চলাচল করতে পারছে না। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীপথে ছয়-সাত বছর ধরে নৌযান চলাচল একেবারেই কমে গেছে। এ ছাড়া বলেশ্বর নদের ওপর নির্মিত শহীদ ফজলুল হক মণি সেতুর উত্তর প্রান্তে তীর ঘেঁষে প্রায় ১ কিলোমিটারজুড়ে জেগে উঠেছে চর। গুরুত্বপূর্ণ এ নদীর বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে।

একইভাবে অব্যাহত দখলের কারণে বরগুনার খাকদোন নদটি মৃত্যুর প্রহর গুনছে। নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর সীমিতভাবে খনন করে নদের কিছু অংশ সচল রেখে নৌ চলাচল স্বাভাবিক রাখলেও নদটির পূর্বাংশে প্রায় ২০ কিলোমিটার মৃতপ্রায়।

পায়রা ও বিষখালীরও একই অবস্থা

দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নৌরুট হলো পায়রা ও বিষখালী নদী। এই নদী দুটির সঙ্গে ঢাকা ও বঙ্গোপসাগরের সরাসরি নৌযোগাযোগ থাকায় এই নৌরুট খুব গুরুত্বপূর্ণও। অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথ হিসেবে স্বীকৃত পায়রা নদীর বরগুনা অংশে চরপাড়ায় ১ কিলোমিটার, বুড়িরচরে ৫ কিলোমিটার, লোচা থেকে শুরু করে ওয়াপদা স্লুইসগেট পর্যন্ত ২ কিলোমিটার, জাঙ্গালিয়ায় ২ কিলোমিটার, ডালাচারা থেকে তিতকাটা পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার ও কাঁকচিড়া থেকে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশাল ডুবোচর রয়েছে। বরগুনার আমতলী ফেরিঘাট এলাকায় কয়েক কিলোমিটারজুড়ে বেশ কয়েকটি ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে।

এতে এ স্থান দিয়ে ভাটার সময় ফেরিসহ কোনো নৌযান চলাচল করতে পারছে না। চর ক্রমে বিস্তৃত হয়ে পশরবুনিয়া, গুলিশাখালী, জাঙ্গালিয়া, আয়লা, ক্যামঘাট, বিঘাই ছাড়িয়ে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ, পায়রাকুঞ্জ, রাজগঞ্জ ও লেবুখালীতে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এসব পথ দিয়ে লঞ্চ-ফেরিসহ বড় বড় নৌযান ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। বড় নৌযানগুলো ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ঘুরে চলাচল করতে বাধ্য হয়। আবার পটুয়াখালীর লেবুখালী থেকে রায়পুরা, দুর্গাপাশা হয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জের পাটকাঠি পর্যন্ত যেতে অসংখ্য ডুবোচর থাকায় এই পথে লঞ্চ চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং নিরাপদে তুলনামূলক কম খরচে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য সব নদ-নদীর নাব্যতা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি।

নদীর বিপন্ন দশা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় আহ্বায়ক রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদী আমাদের প্রাণ ও সংস্কৃতির অংশ। কেননা নদীর প্রবাহের সঙ্গে অনেক উপকারী উপাদান আছে, যার মাধ্যমে নদী, ভূমি ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জলজ, প্রাণিজ উদ্ভিদ, প্রাণী, কৃষি ও জীবন-জীবিকাকে সমৃদ্ধ করে। তাই নদী না বাঁচলে আমাদের প্রাণপ্রবাহ থমকে যাবে।’ নদীগুলোকে রক্ষা করতে হলে প্রথমে এসব নদীর হাইড্রোলজিক্যাল সমীক্ষা চালিয়ে নদীর মানচিত্র তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন এই পরিবেশ আন্দোলনকর্মী।