ফেসবুক গ্রুপ বদলে দিল শ্রীপুর স্টেশন

রোববার সন্ধ্যা ছয়টা। আবছা অন্ধকারে গাজীপুরের শ্রীপুর রেলস্টেশন। নিত্যদিনের চিরচেনা ঘোষণার বাইরে হাতমাইকে অপরিচিত ঘোষণা শুনে অনেকেই অবাক।

ঘোষণায় বলা হয়, ‘অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ট্রেন আসার পূর্বে কোনো যাত্রী হলুদ দাগ বা সেফটি লাইনের ভেতর প্রবেশ করবেন না। যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলবেন না। বাংলাদেশ রেলওয়ের মনোগ্রামসহ ডাস্টবিন আছে আপনার আশপাশেই। ময়লা ফেললে সেখানে ফেলুন। প্ল্যাটফর্মের পরিবেশ সুন্দর রাখুন। ছাদে ভ্রমণ করবেন না। সবাই সেফটি লাইনের বাইরে অবস্থান করুন। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করলে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ট্রেনে উঠুন।’ তরুণদের এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগে পাল্টে যাচ্ছে রেলস্টেশনের চেহারা।

এই ঘোষণা আসে রেলস্টেশনের একদল তরুণের হাতমাইক থেকে। স্পেশাল রেসপন্স টিম বা এসআরটি নামের একটি স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য তাঁরা। গাজীপুর জেলা থেকে সংগঠিত ৫৭ হাজার সদস্যসমৃদ্ধ ‘গাজীপুর ট্রেন প্যাসেঞ্জারস ফোরাম’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে তৈরি হয়েছে দলটি। এই দলের সদস্যরা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও যাত্রীদের তথ্য সরবরাহে বিস্ময়কর পরিবর্তন এনেছেন। তাঁরা ১০-১২ জন প্রতিদিন পালাক্রমে স্টেশনে দায়িত্ব পালন করেন। হাতে বাঁশি, হাতমাইক, লেজার ইন্ডিকেটর নিয়ে পুরো রেলস্টেশন চত্বরে তৎপরতা চালান তাঁরা। ট্রেন কখন আসবে, কোথায় গন্তব্য বা কোথা থেকে টিকিট কাটতে হবে—এসব তথ্য মাইকে প্রচার করতে থাকেন তাঁরা। কয়েকজন সদস্য লেজার ইন্ডিকেটরের মাধ্যমে যাত্রীদের বারবার সেফটি লাইনের বাইরে অবস্থান করতে বলেন। কেউ ময়লা ফেললে তাঁকে সতর্ক করা হচ্ছে। যাত্রীদের মধ্যে যাঁরা পরিবেশ দূষণ করছেন, তাঁদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে। অনেকে তরুণদের এই উদ্যোগের প্রশংসা করছেন।

এসআরটির সদস্যরা জানান, তাঁদের হাত ধরে রেলস্টেশনের অবহেলিত স্থানগুলো পরিণত হয়েছে পরিচ্ছন্ন স্থানে। রেলস্টেশনের যেসব স্থানে মানুষ শৌচাগারের কাজ করতেন, এখন সেখানে ময়লাও ফেলেন না তাঁরা। স্থানীয় লোকজন রেলওয়ের যেসব স্থানে ঘুরতে আসেন, সে স্থানগুলোতে লাগানো হয়েছে বাহারি গাছ। প্ল্যাটফর্মে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি শৌচাগার। লোকজনকে শৌচাগার ব্যবহারে উৎসাহিত করছেন তাঁরা। গত কয়েক মাসে স্টেশনের সার্বিক চিত্র পরিবর্তনের জন্য তাঁদের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল নিরাপত্তারেখা অঙ্কন, একটি প্রস্রাবখানা তৈরি, বাগান তৈরি, দেয়ালে বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি লেখা, শীতবস্ত্র বিতরণ, আলোর জন্য বাতি স্থাপন, ট্রেনের সময়সূচি সহজ ভাষায় হ্যান্ডবিল আকারে যাত্রীদের সরবরাহ, অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদে স্টেশনমাস্টারকে সহযোগিতা করা, প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট স্থানের চারপাশে জাল দিয়ে বাউন্ডারি নির্মাণ ও পরিচ্ছন্নতার জন্য কর্মী নিয়োগ দেওয়া। এ পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়া পাঁচ শিশুকে উদ্ধার করে তাঁরা স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেন।

এসআরটির সদস্যরা জানান, গাজীপুর ট্রেন প্যাসেঞ্জারস ফোরামের ৫৭ হাজার সদস্য যে যেখানে আছেন, সেখান থেকেই তাঁদের আশপাশে থাকা ট্রেনের অবস্থান ফেসবুকে শেয়ার করছেন। এই কার্যক্রম চলছে দেশব্যাপী। গ্রুপের দুটি দল এসআরটি বা স্পেশাল রেসপন্স টিম হিসেবে বের হয়ে জয়দেবপুর রেলজংশন ও শ্রীপুর রেলস্টেশনে কাজ শুরু করে। শ্রীপুর রেলস্টেশনের এসআরটি দলের মডারেটর সংখ্যা ২৩ ও অ্যাডমিন সংখ্যা ৪।

শ্রীপুর রেলস্টেশনে এসআরটি সদস্যদের আঁকা সেফটি লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা।  প্রথম আলো
শ্রীপুর রেলস্টেশনে এসআরটি সদস্যদের আঁকা সেফটি লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা। প্রথম আলো

ওই দলের সদস্যরা আরও জানান, দলের ৩২ জন সদস্যের মধ্যে প্রতিদিন ১০–১২ জন পর্যায়ক্রমে স্টেশনে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন এরিয়া কমান্ড্যান্টের অধীনে চারজন ক্যাপ্টেন ও চারজন কো-ক্যাপ্টেন কাজ করেন। একজন অ্যাডভাইজার এসআরটি দলকে পরামর্শ দেন। সারা সপ্তাহের কাজ নিয়ে প্রতি সপ্তাহে বৈঠক হয়। টিম বিল্ডিংয়ের জন্য প্রতি সপ্তাহে বৈঠক হয়। এসব দায়িত্বের পাশাপাশি তাঁরা সমাজকে মাদকমুক্ত রাখতে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ‘মাদকমুক্ত শ্রীপুর’ স্লোগানে সাইকেল শোভাযাত্রার আয়োজন করেন।

সদস্য সংগ্রহ বিষয়ে সদস্যরা জানান, কার্যক্রম দেখার পর অনেকেই এ কাজে আগ্রহী হয়ে যুক্ত হতে চান। একদম স্বেচ্ছাশ্রমে আগ্রহী হলে, মাদক না নিলে, নিজ এলাকার উন্নয়নে কাজ করার মানসিকতা থাকলে প্রাথমিকভাবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রথম সাত দিনে একজন নতুন সদস্য বাঁশি পান। ১৫ দিন পর আইডি কার্ড দেওয়া হয়। এক মাস পর এসআরটির টি–শার্ট পান তিনি। এক মাসের মাথায় তাঁকে চূড়ান্ত সদস্য করা হয়।

ট্রেনের যাত্রী রাশেদুর ইসলাম বলেন, ‘স্টেশনের ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছেন এসআরটির সদস্যরা। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তাঁদের এই কার্যক্রম প্রশংসনীয়।’

এসআরটির শ্রীপুরের এরিয়া কমান্ড্যান্ট তুহিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা শ্রীপুর স্টেশনকে মডেল রেলস্টেশনে পরিণত করতে চাই। সারা দেশে প্ল্যাটফর্মের যে চিত্র, তার থেকে ব্যতিক্রম হবে এই স্টেশন। ’ শ্রীপুর রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার সাইদুর রহমান বলেন, ‘তাঁদের কার্যক্রম স্টেশনমাস্টার হিসেবে আমার খুব ভালো লাগে। যাত্রীদের ওঠানামায় তাঁরা যে সহযোগিতা করেন, তা অবিশ্বাস্য। তাঁদের প্রত্যেক সদস্যই তরুণ, খুব ভালো তাঁরা। তাঁদের তারুণ্যের এই উদ্যম একটা ভালো কাজে লাগাচ্ছেন দেখে মনে হয়, এ দেশে এখনো মানুষের পাশে দাঁড়ানো লোকের অভাব নেই।’