রেজাউল-আউয়াল-এ্যানী দ্বন্দ্বে টালমাটাল রাজনীতি

শ ম রেজাউল করিম, এ কে এম এ আউয়াল, এ্যানী রহমান। ফাইল ছবি
শ ম রেজাউল করিম, এ কে এম এ আউয়াল, এ্যানী রহমান। ফাইল ছবি

মন্ত্রী, সাংসদ ও জেলার সভাপতি—ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে টালমাটাল পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এর মধ্যে পিরোজপুর-১ আসনের সাংসদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের সঙ্গে সাবেক সাংসদ এ কে এম এ আউয়াল পরিবারের দ্বন্দ্ব এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রকট।

স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট এই দ্বন্দ্বে আরেক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ এ্যানী রহমান। জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও পৌর নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

মাঠপর্যায়ে দলীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পিরোজপুরে আওয়ামী লীগে সক্রিয় তিনটি পক্ষের একটি সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আউয়ালের পরিবারকেন্দ্রিক। তাঁর ভাই পিরোজপুর পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান এখন এই পক্ষের নেতৃত্বে আছেন। প্রভাবশালী এই পক্ষের বিপরীতে শ ম রেজাউল করিমকে ঘিরে রয়েছে আরেকটি পক্ষ। এই মুহূর্তে শ ম রেজাউলের সঙ্গে আউয়াল পরিবারের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে এ্যানী রহমানের অনুসারীরা আপাতত চুপচাপ রয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, আউয়াল ও রেজাউল করিমের বিরোধ অনেক পুরোনো। শ ম রেজাউল করিম পিরোজপুরে ও নাজিরপুরে আইন পেশায় যুক্ত থাকার সময় থেকেই আওয়ামী লীগে আউয়ালবিরোধী অংশের সঙ্গে ছিলেন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে নানা বিতর্কে জড়ান আউয়াল। নিজের ভাই হাবিবুর রহমানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এলাকার রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। তখন দুই ভাই-ই এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান শ ম রেজাউল করিম। তখন হাবিবুর রহমান হাত মিলিয়েছিলেন শ ম রেজাউলের সঙ্গে। শ ম রেজাউল সাংসদ ও মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে ঘিরে আওয়ামী লীগে আউয়াল পরিবারবিরোধী একটি পক্ষ সক্রিয় হয়। আউয়ালের অনুসারীদের অনেকেই পক্ষ ত্যাগ করেন। ফলে রেজাউল করিম–সমর্থিত অংশের প্রভাবও বেড়ে যায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় আউয়ালের ভাই ও পৌর মেয়র হাবিবুর রহমানের সঙ্গে শ ম রেজাউ​ল করিমের দ্বন্দ্ব বাধে। একপর্যায়ে পারিবরিক আধিপত্য ঠিক রাখতে আউয়াল ও হাবিবুর দুই ভাই আবার এক হয়ে যান।

>

আউয়াল পরিবারের বিপরীতে সক্রিয় দুটি পক্ষ। তাতে আছেন মন্ত্রী শ ম রেজাউল ও সাংসদ এ্যানী রহমানের অনুসারীরা।

একাধিক সূত্র জানায়, রেজাউল ও হাবিবুরের এই দ্বন্দ্বের বড় কারণ জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির নেতৃত্ব পরিবর্তন। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন আউয়ালের ছোট ভাই মসিউর রহমান (মহারাজ)। তিনি এই পদ হারান। নতুন করে সভাপতি হন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন খান। যিনি শ ম রেজাউল করিমের অনুসারী।এসব ঘটনার ​পরিপ্রেক্ষিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান ও মসিউর রহমান তাঁদের বড় ভাই আউয়ালের সঙ্গে এক হয়ে যান।

হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে তিনটি মামলা হয়েছে। মন্ত্রীর প্রভাবে সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। মন্ত্রীর প্রভাবে পুলিশ প্রহরায় বাস মালিক সমিতি দখল করা হয়েছে।

অবশ্য শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাস মালিক সমিতির নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না।

আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, আগামী মাসে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। আবারও সভাপতি হতে চান আউয়াল। এ বছরের শেষে পৌরসভা নির্বাচন। সেখানে বর্তমান মেয়র হাবিবুর রহমানের বিপরীতে মন্ত্রী রেজাউল অন্য কাউকে প্রার্থী দেবেন, এমন আলোচনা আছে। এমন প্রেক্ষাপটে আউয়াল পরিবার শঙ্কিত ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা নিয়ে। তাদের আশঙ্কা ছিল এই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে নেওয়া জামিনের মেয়াদ শেষে আউয়াল দম্পতিকে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। সেটা হলে পিরোজপুরের রাজনীতিতে তাঁদের প্রভাব আরও কমে যাবে। ৩ মার্চ জেলা জজ আদালত প্রথমে আউয়াল দম্পতিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলে তাঁদের অনুসারীরা সড়ক অবরোধ করেন। পরবর্তী সময়ে বিচারককে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয় এবং ভারপ্রাপ্ত বিচারক আউয়াল দম্পতির জামিন মঞ্জুর করেন।

আউয়াল অভিযোগ করেন, মন্ত্রী শ ম রেজাউল প্রভাব খাটিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের মাধ্যমে মামলা করিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্বন্দ্ব যদি বলেন, এটা একপেশে ওনার (মন্ত্রী) তরফ থেকে। আমার পক্ষ থেকে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।’

মন্ত্রীর সঙ্গে আউয়াল পরিবারের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে সম্প্রতি আউয়ালের জামিন ও বিচারক বদলির ঘটনার পরপর। সংবাদ সম্মেলন করে আউয়াল মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, দুদককে প্রভাবিত করে মামলা করানো যায়, এমন অভিযোগ হাস্যকর। দুদক নিজেদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে কোনো অভিযোগের সত্যতা পেলে তখনই মামলা করে। তিনি বলেন, এ কে এম এ আউয়াল একাধিকবার সাংসদ ছিলেন। এবার প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ায় আউয়াল ও তাঁর অনুসারীরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হন।

সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিরোজপুরের রাজনীতিতে এখন যে ত্রিমুখী দ্বন্ধ, সেটার মূল কারণ আওয়ামী লীগে আউয়াল পরিবারের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে। আগামী মাসে দলের জেলা সম্মেলনে নেতৃত্বে কে আসেন, সেটার ওপর নির্ভর করছে শেষ পর্যন্ত কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে পিরোজপুরের রাজনীতির মাঠ।

আগামী পর্ব: ভাইদের কাঁধে ভর করে মাঠ দখলের ​চেষ্টায় আউয়াল