ইকোট্যুরিজমের নামে বনকে বিপদে ফেলার আয়োজন?

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি: প্রথম আলো
মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ‘ইকোট্যুরিজম’ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের বড় পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৫০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শুরু হলে সংরক্ষিত এ বনের মধ্যে রীতিমতো ইট-পাথরের কর্মযজ্ঞ চলবে।

এ অবস্থায় পরিবেশকর্মীরা কয়েক ধরনের উদ্বেগের কথা বলছেন। প্রথমত, প্রকল্পের যে কর্মযজ্ঞ চলবে, তা বনের প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্প পরিকল্পনায় যেসব বিষয় রাখা হয়েছে, তার কয়েকটি বাস্তব রূপ নিলে বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে। তাঁদের মতে, সংবেদনশীল এ বনকে বাঁচাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে সরে এসে প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য রক্ষায় সত্যিকারের পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা নিতে হবে। তা না হলে বন, বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য বিপদে পড়বে। কেবল বাণিজ্যিক চিত্তবিনোদন, বনভোজন ও স্রেফ ভোগবিলাসের কেন্দ্রে পরিণত হবে লাউয়াছড়া।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সিলেট বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) আ ন ম আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের (পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন) আগ্রহে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তিনি চাইছেন এলাকার উন্নয়ন করতে। অনেকে মনে করছেন, এতে করে ইট-কাঠের জঞ্জাল হয়ে যাবে বন। আসলে এ রকম কিছু হবে না। উদ্যানের কোর (মূল) এলাকায় কিছু করা হবে না। জীববৈচিত্র্য নিয়ে জরিপ করা হবে। মানুষের উপস্থিতিও সীমিত করতে একটা ব্যবস্থা থাকবে। এ নিয়ে কারও কোনো প্রস্তাব থাকলে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যদি কোনো জায়গা আনটাচ (অক্ষত) রাখলে ভালো হয়, তা–ই রাখা হবে। পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করেই উন্নয়নকাজ করা হবে।’

বন বিভাগ ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের নেওয়া ওই প্রকল্প পরিকল্পনার নাম ‘লাউয়াছড়া-সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক বনায়ন ও ইকোট্যুরিজম উন্নয়ন’। এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছে বন বিভাগ। এর মধ্যে বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের জন্য ৩ কোটি টাকা ও বাকি প্রায় ৩৫ কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানের জন্য। প্রকল্প প্রস্তাবটি তৈরি করা হয়েছে মূলত বনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের আগ্রহে।প্রকল্প প্রস্তাবটি মৌলভীবাজারে অবস্থিত সিলেট বিভাগীয় বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কার্যালয় থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। ঢাকা থেকে সেটি এখানে ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি পুনর্মূল্যায়ন করে আবার ঢাকায় পাঠানো হবে।এরপর কমিটি হবে। সেই কমিটি প্রকল্পটি মূল্যায়ন করবে। তারপর সেটি বাস্তবায়নের দিকে যাবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে বছরখানেক সময় লাগতে পারে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের উন্নয়নে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনায় আছে অনেকগুলো স্থাপনা নির্মাণ। এর মধ্যে রয়েছে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, বক্স কালভার্ট নির্মাণ, গাড়ির চাপায় বন্য প্রাণীর মৃত্যুরোধে বিদ্যমান সড়কের উভয় পাশে আরসিসি খুঁটিসহ প্লাস্টিকের বেড়া নির্মাণ, গোলঘর নির্মাণ, পাহাড়ের ওপরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে যাওয়ার জন্য আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ, সাইট প্রোটেকশন গাইড ওয়াল নির্মাণ, ওয়াশরুম (একই স্থাপনার এক পাশে দুটি পুরুষ শৌচাগার ও অন্য পাশে দুটি মহিলা শৌচাগার), আরসিসি বসার বেঞ্চ নির্মাণ, পর্যটক চলাচলের রাস্তার সেতু নির্মাণ, সভা-সমাবেশ, প্রশিক্ষণ কর্মশালার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু কনভেনশন হল’ নির্মাণ, আরসিসি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন ধরনের আবাসিক ও অনাবাসিক স্থাপনা মেরামত। বাঘমারা পর্যটন ক্যাম্পের পার্ক এলাকায় প্রবেশতোরণ নির্মাণ, গোলঘর নির্মাণ, প্রবেশতোরণের বিপরীতে শৌচাগার নির্মাণ, প্রবেশতোরণের বিপরীতে পার্কিংয়ের জায়গা তৈরি, ফুল ট্রেইল নির্মাণ, হ্রদ বা পুকুরে আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ, হ্রদের ওপরে ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ, সাইট প্রোটেকশন গাইড ওয়াল, রিটেইনিং ওয়ালসহ হ্রদের চারপাশে হাঁটার রাস্তা নির্মাণ, পর্যটকদের জন্য দ্বিতল প্যাভিলিয়ন (পিকনিক শেড, শৌচাগার, রেস্তোরাঁ, চাইল্ড ফিডিং জোন, শিশুদের খেলার জায়গা ইত্যাদি) নির্মাণ, শিশুদের খেলার উপকরণ, আরসিসি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ, বাঘমারা ক্যাম্প এলাকায় সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ইত্যাদি।

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি: প্রথম আলো
মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি: প্রথম আলো

লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক জলি পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়টি আমরা দেখেছি। আমরা কমিটির লোকজন বসেছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ নিয়ে ডিএফও সাহেবের (বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) সঙ্গে দেখা করব। এ রকম উন্নয়ন হলে বনের প্রাকৃতিক অবস্থা থাকবে না। বনের উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি, বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য রক্ষা; যতটুকু বন নষ্ট হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনা। অবকাঠামো উন্নয়ন কখনোই বনের উন্নয়ন হতে পারে না।’

পরিবেশকর্মী ও গবেষকেরা মনে করছেন, এ উন্নয়ন পরিকল্পনায় যা যা রাখা হয়েছে, সেগুলো যে অন্তত সংরক্ষিত একটা বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না, সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত। এ রকম উন্নয়নের নামে লাউয়াছড়াকে একটা বনভোজন ও বিনোদনের স্থান হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়া কিছুই হবে না। এতে বনের প্রাণী ও উদ্ভিদ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। আর ইকোট্যুরিজমের নামে এ ধরনের বাণিজ্যিক প্রকল্পের বাস্তব চিত্র তাঁরা অতীতেও দেখেছেন। এর আগে মধুপুর শালবনের ক্ষেত্রে এমন প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। তা ওই বনের জন্যও মোটেও ভালো হয়নি।

প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাউয়াছড়ার মতো সংবেদনশীল বনে প্লাস্টিকের বেড়া হলে বন্য প্রাণী বিশেষত সরীসৃপ ও খুদে প্রাণীদের চলাচল সীমিত হবে। যেহেতু বনের ভেতর রাস্তাটি বন্ধ করা যাচ্ছে না, তাই গাড়িচালকদের বন-ট্রাফিকের মাধ্যমে বিশেষ সতর্কতায় গাড়ি চালাতে হবে।’ পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে লাউয়াছড়া তার বনভূমির বৈশিষ্ট্য হারাবে এবং এটি স্রেফ একটি বাণিজ্যিক বনভোজন কেন্দ্রে পরিণত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন বিভাগকে এ পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে। সত্যিকার অর্থে লাউয়াছড়ার বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য সুরক্ষায় কাজে লাগবে, এমন উদ্ভাবনী পরিকল্পনা নিতে ও বাস্তবায়ন করতে হবে।