৫৭ বছরে শুকিয়ে গেছে ১৫৮ নদী

ভৈরব নদের যশোর শহর অংশের খননকাজের মেয়াদ বাকি আর চার মাস। কাজ হয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ। গতকাল যশোর শহরের দড়াটানা এলাকায়।  ছবি: এহসান-উদ-দৌলা
ভৈরব নদের যশোর শহর অংশের খননকাজের মেয়াদ বাকি আর চার মাস। কাজ হয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ। গতকাল যশোর শহরের দড়াটানা এলাকায়। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

গল্পটা বেশ পুরোনো। কিছুদিন পরপরই সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নদী রক্ষার অঙ্গীকার করা হয়। নদী বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ নিতে আদালত থেকেও সরকারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নদ–নদী খনন ও রক্ষায় বছরজুড়েই নানা উদ্যোগের কথা শোনা যায়। কিন্তু ক্ষমতার আশীর্বাদে দখল ও দূষণ শেষ পর্যন্ত প্রায় অপ্রতিরোধ্যই থেকে যায়। নদী রক্ষার কাজটি প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যার পরিণতি ধীরে ধীরে নদী শুকিয়ে যাওয়া।

দুটি গবেষণার সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে গত ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। ১৯৬৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে নদ-নদীর সংখ্যা কত কমল, সেই সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা ২০১০ সালে প্রকাশ করে বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একদল গবেষক তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাতে বলা হয়, দেশের ১১৫টি নদ-নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায়।

অন্য দিকে নদী, পানি–প্রকৃতি নিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও দখলের কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।

উত্তরণের পরিচালক শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতনা, শালিখা, শালিতা, হামকুড়া, চুনা ও হাতিটানার মতো তীব্র স্রোতের নদী এখন শুকিয়ে বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। মূলত অপরিকল্পিতভাবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।

পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে এক দিকে নদী যেমন শুকিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে পানি দূষিত হওয়ার কারণেও নদী মরে যাচ্ছে। অনেক নদ-নদীতে পানির প্রবাহ আছে ঠিকই, কিন্তু তা এমনভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে যে নদীর পানি আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। এসব নদীর মধ্যে শীর্ষে আছে বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী।

দেশের নদ-নদীর পানির গুণগত মান কেমন, তা নিয়ে ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত ১৪৩টি গবেষণা সমীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক মো. খালিদ হাসাদ, আবরার শাহরিয়ার ও কুদরত উল্লাহ। তাঁদের বিশ্লেষণ ২০১৯ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী হেলিয়ন–এ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, দেশের ৩২টি নদীতে নানা মাত্রায় মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত ধাতু পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এরপরই বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীতে এসব দূষিত পদার্থ পাওয়া গেছে।

দেশের নৌপথের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ), নদীর তীর রক্ষা ও খননের কাজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের, নদীর জমির মালিক হিসেবে তার ইজারা দিচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়। নদীর পানির মান দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। মৎস্যসম্পদ দেখে মৎস্য অধিদপ্তর। নদীতে থাকা কুমির, ডলফিনের মতো প্রাণী সুরক্ষার দায়িত্বে বন বিভাগ। আবার নদী থেকে সেচের ব্যবস্থা ও রাবার ড্যাম (বিশেষ ধরনের বাঁধ) তৈরি করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন। নদী থেকে পানি তুলে পরিশোধন করে তা শহরে সরবরাহ করছে ওয়াসা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। আর সামগ্রিকভাবে নদী রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গত মাসেই ৩৯ হাজার ৫৫৮ জন নদী দখলদারের হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করেছে। এ তালিকা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি দখলদার রয়েছে কুমিল্লা জেলায়। এসব দখলদারের মধ্যে দেশের অনেক প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপ, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিবিদের নামও রয়েছে। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করার অভিযানে সরকারদলীয় সাংসদ হাজি সেলিম ও তুরাগ দখলমুক্ত করার সময় সাংসদ আসলামুল হকের বাধা দেওয়ার ঘটনায় নদীর ভূমি দখলে রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি সামনে এসেছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, নদীর দখলদারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও দখলদারদের উচ্ছেদ একই সঙ্গে চলছে। সব দখলদারকে উচ্ছেদ করে নদীকে তার জায়গা ফিরিয়ে দিয়ে প্রাকৃতিক প্রবাহ নিশ্চিত করা হবে বলে তিনি জানান। তবে কমিশন এখন পর্যন্ত দেশে নদীর প্রকৃত সংখ্যা কত, তার কোনো জরিপ করেনি।

দেশে ঠিক কতটি নদী আছে, সে তথ্যও সরকারি কোনো সংস্থার কাছেই নেই। দেশের নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে সরকারি উদ্যোগে সর্বশেষ জরিপটি হয় প্রায় ১০ বছর আগে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২০১১ সালে বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক ছয় খণ্ডের একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়, নদ-নদীর মোট সংখ্যা ৪০৫।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসার ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি ও মাঠপর্যায়ে জরিপ চালিয়ে পাউবো নদ-নদীর তালিকাটি তৈরি করে। অবশ্য এর আগে পাউবো ২০০৫ সালে বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। সেখানে দেখানো হয়েছিল নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০। তবে বাংলাপিডিয়াসহ সরকারি বিভিন্ন নথিতে নদীর সংখ্যা কোথাও ৭০০, কোথাও ৮০০। আর লোককথা ও সাহিত্যে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা হাজারের বেশি বলা হয়।

তবে জরিপটি প্রকাশের এক বছর পর ২০১২ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে উল্লেখ করেন, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০। এর মধ্যে ২১২টি নদী ভালোমতো প্রবহমান, ৯৭টি নদী মৃতপ্রায়। আর স্বাধীনতার পর বাগেরহাটে ভোলা নামে একটি নদী পুরোপুরি মরে গেছে।

বাংলাদেশ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ওয়ারপোর সাবেক মহাপরিচালক ও নদী গবেষক ম. ইনামুল হক দেশের নদ-নদী নিয়ে প্রায় দুই যুগ ধরে গবেষণা করছেন। ২০১৯ সালে তাঁর লেখা বাংলাদেশের নদ-নদী বইয়ে ১ হাজার ৫১৬টি নদীর উল্লেখ আছে।

দূষণে-দখলে মৃতপ্রায় নদী বাঁচাতে আজ ১৪ মার্চ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন, আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনসহ পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। তারা দিনটি ‘আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস’ বা নদী রক্ষায় করণীয় দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। ১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্বের কয়েকটি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলে একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে নদীকৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদীর প্রতি মানুষের করণীয় কী, নদী রক্ষায় মানুষের দায়বদ্ধতা কতটুকু—এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয় ব্রাজিলের ওই সম্মেলনে। বাপা বলছে, এ বছর দেশে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বাঁধ-জলকপাট-দখল ও দূষণমুক্ত নদীপ্রবাহ নিশ্চিত করো। আংশিক নয়, নদীবিষয়ক হাইকোর্টের রায়, সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করো।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ৮০ শতাংশ ভূমি গঠিত হয়েছে নদী থেকে আসা পলি দিয়ে। আর এখানকার নদীগুলো জালের মতো বিস্তৃত, একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। তাই একটি নদী কোনো কারণে শুকিয়ে গেলে বা আরেকটির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তার প্রভাব অন্য নদীর ওপরে পড়ে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে নদ-নদীতে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে এর পানিপ্রবাহের সঙ্গে পলির ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আবার যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। ষাটের দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ১০০ নদী শুকিয়ে গেছে।