খুলনায় আমনে ক্ষতি, তরমুজে ঝোঁক

তরমুজখেত প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। গত শুক্রবার দাকোপের খেজুরিয়া গ্রামের একটি মাঠে।  ছবি: প্রথম আলো
তরমুজখেত প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। গত শুক্রবার দাকোপের খেজুরিয়া গ্রামের একটি মাঠে। ছবি: প্রথম আলো

খুলনায় আমন ধানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তরমুজ নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন চাষিরা। মাঠে মাঠে এখন কিষান–কিষানির ব্যস্ততা। অল্প সময়ে বেশি লাভ হওয়ায় বছর বছর তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা। আর আমনের ক্ষতি পোষাতে এবার সেই ঝোঁক আরও বেড়েছে।

তরমুজচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত তরমুজ চাষের মৌসুম শুরু হয় ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে। কিন্তু এ সময় জেলার তরমুজ চাষের অধিকাংশ জমিতে কাদাভাব থাকায় মাসখানেক দেরিতে তরমুজ চাষ করেন কৃষকেরা।

গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দাকোপ উপজেলার খেজুরিয়া, উত্তর বানীশান্তা, কালিকাবাটি, হরিনটানা, লাউডোব, কৈলাশগঞ্জ, ধোপাদী, দাকোপ, পশ্চিম বাজুয়া, পূর্ব বাজুয়া এবং বটিয়াঘাটা উপজেলার বরণপাড়া, গঙ্গারামপুর, বয়ারভাঙা, দেবীতলাসহ অন্তত ২০টি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সব গ্রামেই এখন তরমুজচাষিদের ব্যস্ততা। খেত ঘিরে একধরনের প্রাণচাঞ্চল্য কাজ করছে। বেশির ভাগ মাঠে বীজ রোপণ করা হয়ে গেছে। দু-এক জায়গায় এখনো জমি প্রস্তুতির কাজ চলছে। কোথাও আবার চারা বাড়তে শুরু করেছে। সার, পানি ও কীটনাশক ছিটানোয় ব্যস্ত সময় পার করছেন কিষান-কিষানিরা। মৌসুমি নারী শ্রমিকেরা মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের মধ্যে এই জেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের চাষ হয়। বছর বিশেক ধরে আবাদ হলেও ২০১৪ সালে জেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের আবাদ হয়। ওই বছর জেলায় ৩ হাজার ৪৬৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ হয়েছিল। তবে সেবার ফসল তোলার সময় বৃষ্টি ও খারাপ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে জেলার চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েন। ফলে ২০১৫ সালে জেলায় আগের বছরের ছয় ভাগের এক ভাগ জায়গায় আবাদ হয়। ২০১৭ সাল থেকে আবার একটু একটু বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালে জেলায় ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৮৫ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৮ সালে জেলায় ২ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১৫ হাজার টন তরমুজ হয়েছিল, যার বাজারদর ছিল ১৩৫ কোটি টাকা বেশি। গত বছর ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছিল। নষ্ট হওয়ার পর ছিল সাড়ে ৯০০ হেক্টরের মতো। এ বছর জেলায় তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

তরমুজ আবাদে অন্যতম সুপরিচিত এলাকা খুলনার দাকোপ। জেলার মোট উৎপাদিত তরমুজের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ চাষ হয় এই উপজেলায়। এখানকার পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ এই ফসল আবাদের সঙ্গে জড়িত। আগে থেকে চাষ হওয়া এলাকার সঙ্গে এবার তিলডাঙ্গা, পানখালী এবং কামারখোলা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে নতুন করে এই আবাদ হচ্ছে।

দাকোপের বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৩০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দাকোপের অধিকাংশ কৃষিজমি একসময় একফসলি ছিল। ১৯৯৫ সালের দিকে কিছু জমিতে তরমুজের চাষ করা হলেও পরিমাণে তা ছিল খুবই কম। কিন্তু সিডরে এলাকার কৃষক বড় ধাক্কা খান। এরপর আয় বাড়াতে এলাকায় তরমুজ চাষ বাড়তে থাকে। সাধারণ হিসাবে তরমুজ চাষে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়, খরচ বাদে সেই সমপরিমাণ টাকা মুনাফাও হয়।

গত বছর এ উপজেলায় ৯১৭ হেক্টর জমিতে আবাদও করা হয়েছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত কয়েক দফা বৃষ্টিপাতে ৭০০ হেক্টর জমির তরমুজ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। এ বছর এখন পর্যন্ত ১ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।

দাকোপের কালিকাবাটি গ্রামের কৃষক জবা রানী বলেন, ‘এবার ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এবং পোকার কারণে আমন ধান পাওয়া যায়নি বললেই চলে। বিঘায় ৭-৮ মণের বেশি ধান হয়নি। এখন ১২ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। গত বছর বৃষ্টিতে তরমুজের ক্ষতি হয়েছিল। এ জন্য এবার উঁচু–নিচু সব ধরনের জমিতে চাষ করেছি। আবহাওয়া ভালো থাকলে সব ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।’

বটিয়াঘাটার বয়ারভাঙা এলাকার কৃষক ও কৃষক সংগঠনের নেতা কাঁকন মল্লিক বলেন, আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং গত বছর ভালো বাজার পাওয়ায় বটিয়াঘাটার প্রচুর কৃষক এবার তরমুজে ঝুঁকেছেন। তরমুজে কিছুটা ঝুঁকি থাকে, তারপরও গঙ্গারামপুর ও সুরখালী ইউনিয়নের অর্ধেকের বেশি কৃষক এবার কমবেশি তরমুজ চাষ করছেন।

বটিয়াঘাটার সানকেমারী গ্রামের কৃষক প্রিয়ব্রত রায় বলেন, ‘গত বছর তরমুজে ব্যাপক লাভ করেছিলেন বটিয়াঘাটার কৃষকেরা। দাকোপের কৃষকেরা বৈরী আবহাওয়ার কারণে লস (ক্ষতি) করায় দাম পেয়েছিল বটিয়াঘাটার কৃষকেরা। গত বছর আমার ৮ বিঘায় ১৩ লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। এবার প্রচুর চাষি তরমুজ করছেন।’

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, প্রাকৃতিক কারণে গতবারের কয়েকটি এলাকার তরমুজচাষিরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, অনেকে ব্যাপক লাভ করেছিলেন। এবার জোরেশোরে চাষিরা তরমুজ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন।