পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের দখলদার সরকার ও প্রভাবশালীরা

প্রাকৃতিক কারণে এমনিতেই পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অবস্থা মৃতপ্রায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দখলদারদের তৈরি নানা স্থাপনা। গত শুক্রবার ময়মনসিংহের পাটগুদাম এলাকায়।  প্রথম আলো
প্রাকৃতিক কারণে এমনিতেই পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অবস্থা মৃতপ্রায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দখলদারদের তৈরি নানা স্থাপনা। গত শুক্রবার ময়মনসিংহের পাটগুদাম এলাকায়। প্রথম আলো

ময়মনসিংহ শহরের জিরো পয়েন্টের ডান দিকে কে বি ইসমাইল রোডকে মানুষ চেনে কালীবাড়ি সড়ক নামে। সড়কের গোড়ায় ডান দিকে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়। বাঁ দিকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ময়মনসিংহ শহর রক্ষা বাঁধ। বাঁধের ওপর শতাধিক ভবনের জট। 

আছে সিটি করপোরেশনের বিনোদনকেন্দ্র বিপিন পার্ক ও যানবাহন রাখার জায়গা মেয়র পরিবারের গ্যারেজের চিহ্ন আর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। 

ভবনগুলোর মধ্য দিয়ে সরু গলিপথ ধরে এগোলে ধু ধু বালুর মাঠ। মাঠের বুকের মধ্যে একটি শীর্ণ খালের ধারা। কালচে পানির কাছাকাছি যেতে নাকে বোঁটকা গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। স্থানীয় লোকজন বললেন, এটাই নাকি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ—বালুর চড়ায় দমবন্ধ, দখল আর দূষণে মৃতপ্রায়।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গত মাসের শেষ দিকে দেশের নদী-খাল দখলদারদের সর্বশেষ তালিকাটি প্রকাশ করেছে। সেটা অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র দখলের শীর্ষে রয়েছে খোদ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন। আছে মেয়র ও তাঁর ভাইয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। আছে অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। 

কমিশনের তালিকা বলছে, পুরো জেলায় নদী-খাল দখল করে ২ হাজারের বেশি স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

সদরেই দেড় হাজার! 

শহরের উত্তর সীমান্তে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র আর তার বাঁধ। ২ মার্চ বাঁধ পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের দিকে এগোলে ধু ধু বালুর চড়ায় বেশ কিছু ভাঙা ঘরবাড়ি দেখা গেল। স্থানীয় মানুষজন বললেন, ঘরবাড়িগুলো নদী দখল করে গড়ে উঠেছিল। 

গত জানুয়ারি থেকে জেলা প্রশাসন এসব ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করছে, আগে থেকে চলছিল খননকাজ। বাঁশ ও বেড়ার কাঠামোগুলোতে ভেজা কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে। আশপাশে অনেকে বসে আছেন, ঘোরাফেরা করছেন। তবে বেড়িবাঁধের ওপর গড়ে ওঠা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্থাপনাগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। 

নদী রক্ষা কমিশনের তালিকা অনুযায়ী দখলদার স্থাপনাগুলোর সাতটি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে আছে কাঁচাবাজার, গাড়ির গ্যারেজ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়। তালিকায় মেয়র ইকরামুল হক ও তাঁর বড় ভাই আমিনুল হক শামীমের মালিকানাধীন শামীম এন্টারপ্রাইজের কার্যালয়ের একাংশের কথাও আছে। 

বাঁধের ওপর এখনো আছে সরকারের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সড়ক ও জনপথ বিভাগের দপ্তর। আছে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় সংসদের জেলা কার্যালয়ের তিনতলা ভবন। দোতলাটি ভাড়া করেছে সরকারের রূপালী ব্যাংক। সংসদের সাবেক প্রচার ও পুনর্বাসন সম্পাদক বিমল পাল প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯০ সালে এক টাকা মূল্যে সরকার তাঁদের ওই জমি দেয়। সরকারের টাকাতেই ভবনটি উঠেছে।

আর মেয়র ইকরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের কোনো সীমানা চিহ্নিত করা ছিল না। সে জন্যই স্থাপনাগুলো গড়ে উঠতে পেরেছে। তিনি বলেন, তাঁদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের যে অংশ নদীর মধ্যে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেটা তাঁরা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে দেখা যায়, সেখানে এখনো গাড়ি রাখা হচ্ছে।

কমিশনের দখলদার তালিকায় কালু শাহের মাজার, বুড়ো পীরের মাজার, ফালাহ মসজিদ, হিন্দু ধর্মশালা, লোকনাথ আশ্রম, কালীবাড়ি পূজামণ্ডপ, সৎসঙ্গ অধিবেশন কেন্দ্র, বিশ্বনাথ মন্দিরসহ বেশ কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম আছে। 

এর আগে ২০১৫ সালের নভেম্বরে একবার নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করেছিল জেলা প্রশাসন। কিন্তু পরে তা থেমে যায়। তারপর গত ডিসেম্বরে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যৌথ উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে। 

অভিযানে তখন পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি বসতঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে ভাঙা পড়েছে মূলত বালুর চড়ার বস্তি, গুদাম ও বাজার। বাঁধের ওপরে কিছু ভাঙার চিহ্ন দেখা যায় না। ৩ মার্চ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার সরেজমিনে ঘুরে দেখেন। তিনি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত উচ্ছেদ শুরু করার নির্দেশ দেন। 

মুজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খননও করা হবে। আর দখলকারী যতই প্রভাবশালী হোন না কেন, তাঁকে ছাড় দেওয়া হবে না। 

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) গত জুলাই মাসেই ব্রহ্মপুত্রসহ চারটি নদীর খনন প্রকল্প শুরু করেছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের জন্য প্রায় পৌনে তিন হাজার কোটি টাকা বাজেটের পাঁচ বছর মেয়াদি এই খনন প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ নদীর সীমানা নির্ধারণ।

প্রকল্পের পরিচালক রকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নদীর দুই পাড়ের সীমানা চিহ্নিত করে লাল নিশানা বসানো হচ্ছে। সেই সীমা ধরে খনন করে নদী ও খালগুলোকে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। 

নদী রক্ষা কমিশনের তালিকা বলছে ময়মনসিংহ জেলার ১৩টি উপজেলায় অবৈধ স্থাপনার দুই-তৃতীয়াংশের অর্ধেকের বেশি রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা সদরে। আর ৩৪২টি স্থাপনা নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে নান্দাইল উপজেলা।

জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নদীকে দখলমুক্ত রাখতে সরকারি প্রতিষ্ঠান, অন্যান্য ব্যক্তি আর সংস্থাগুলোকে স্থাপনা সরাতে বলা হয়েছে। খুব শিগগির বিশেষ অভিযান চালানো হবে।

দূষণ ভয়ংকর

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাদেকুর রহমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানির গুণগত মান নিয়ে ২০১৯ সালে একটি গবেষণা করেন। মালয়েশিয়ার পানির মানের সূচকের সঙ্গে এর গুণগত মান পরীক্ষা করে তিনি বলেন, এখানকার পানি পান করা তো দূরে থাক, এখানে জলজ প্রাণীও বাঁচবে না। 

ময়মনসিংহ শহরে আছে ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। এর সমন্বয়ক আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, এই নদকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহ শহরের পত্তন হয়েছে। একে যেকোনোভাবে হোক বাঁচাতে হবে।

সিটি করপোরেশন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানার বেশির ভাগ বর্জ্য ওই নদে ফেলা হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, দিনে বর্জ্য পড়ে ৮৯ টন। এডিবির ওই সমীক্ষা বলে, ২০২০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১১৬ টন। তা ছাড়া, কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হওয়া রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অবশেষও নদে গিয়ে পড়ছে।

ময়মনসিংহে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক ফরিদ আহমদ বলছেন, জেলার কোনো সরকারি সংস্থার নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নেই। করপোরেশন, ওয়াসা, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কোনো প্রতিষ্ঠানই এখন পর্যন্ত তরল বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র (ইটিপি) স্থাপন করেনি। কলকারখানারও তা নেই।

ফরিদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বারবার সরকারি সংস্থাগুলোকে ইটিপি বসাতে বলেছেন, চিঠি দিয়েছেন। বেসরকারি কারখানাগুলোকে চাপ দিলে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নজির দেখায়। নদীটি খননের পাশাপাশি এর পানির গুণগত মানও রক্ষা করা উচিত।

ভালুকা উপজেলায় দেশি-বিদেশি প্রায় ১ হাজার শিল্পকারখানা চলছে। বেশির ভাগই ইটিপি ছাড়া। নদী কমিশনের দখলদার তালিকায় ভালুকার বাটারফ্লাই ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, আর্ট কম্পোজিট, কে অ্যান্ড কে ইন্ডাস্ট্রি ও কাঁঠালিয়া ফিশারিজের নাম রয়েছে। তালিকা বলছে, এগুলোর কারখানা স্থাপিত হয়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের দুটি শাখা নদের জমি দখল করে।

মূল ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে ঢুকেছিল কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে। তারপর সে জামালপুর দিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ঢোকে। ২০০ বছর আগে এক তীব্র ভূমিকম্পে মূল নদ সরে গেলে এখানে পড়ে থাকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র।

এ নদের দুর্দশার পেছনে প্রাকৃতিক কারণও আছে। তবে একে ঘিরে যেসব জনপদ প্রাণ পেয়েছে, সেগুলোর মানুষেরাই দখল ও দূষণ ঘটিয়ে নদটির মৃত্যু ডেকে আনছে।