এক্সপ্রেসওয়েতে ৭০ মিনিট

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। ছবি: দীপু মালাকার
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। ছবি: দীপু মালাকার

সদ্য চালু হওয়া ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের অভিজ্ঞতা নিতে গত শনিবার গেলাম ভাঙ্গা পর্যন্ত। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। আর কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর থেকে এই দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। এই পথ বাসে পাড়ি দিতে লেগেছে ৭০ মিনিট। সেই হিসাবে বাকি ৭ কিলোমিটার যেতে সময় লাগে আরও ৯ মিনিট। গুগলও বলছে এই ৭ কিলোমিটার পাড়ি দিতে ৯ মিনিট সময় লাগে।

অবশ্য বাসে করে এই পথ পাড়ি দেওয়ার সময়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত যানের সময় হিসাব মিলবে না। কেননা, বাস চলতিপথে লোক ওঠানো-নামানোর কাজটিও করে। বাস কোম্পানিগুলোর নিজস্ব চেকিংয়েও সময় লাগে।

গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম ও দক্ষিণবঙ্গবাসীর বহুকাঙ্ক্ষিত এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করেন। এ পথে আগে যাঁরা চলাচল করেছেন, তাঁরা ভালোই জানেন, এই এক্সপ্রেসওয়ে কতটা স্বস্তির এই জনপদের জন্য।

যাত্রা শুরু
সকাল ৯টা ১০ মিনিটে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া থেকে বিআরটিসির টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। ওই বাসটির প্রথম যাত্রী হওয়ায় অপেক্ষা করতে হলো আরও যাত্রীর জন্য। বাস ছাড়তে ৯টা ৪০ বেজে গেল। বাসের চালক মো. হামিদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম নতুন সড়ক ব্যবহার করে এখন কত সময়ে মাওয়া পৌঁছানো যাবে? তিনি বললেন, ‘চিন্তা কইরেন না। ঠিক ৪০ মিনিটেই যাইবেনগা।’

ফুলবাড়িয়া থেকে জিরো পয়েন্ট মোড় ঘুরে বাসটি বাবুবাজার সেতুতে উঠতে ঘড়িতে ৯টা ৫২।

ঢাকা-মাওয়া অংশ। ছবি: দীপু মালাকার
ঢাকা-মাওয়া অংশ। ছবি: দীপু মালাকার

এই সেতু থেকে কদমতলী হয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার রাস্তাটি বেশ খারাপ। বাস দুলতে দুলতে চলে। সড়কের এই অংশে এখনো কাজ চলছে।

কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে এসে এক্সপ্রেসওয়েতে বাসটি ওঠে। ঘড়িতে তখন সকাল সোয়া ১০টা।

সড়কটি দেখলে অবশ্য মন ভালো হয়ে যাবে। সড়কদ্বীপে সদ্য লাগানো গাছ গাড়ির গতির বাতাসে কেঁপে ওঠে। সাঁই করে একের পর বাহন চলে যাচ্ছে। রংবেরঙের কাপড় দিয়ে সড়কের দুপাশ সাজানো। যাত্রীছাউনি নির্মাণকাজের সঙ্গে আরও কিছু টুকটাক কাজ চলছে।

সড়কের বিভিন্ন স্থানে গাড়ির গতি ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে রাখার নির্দেশ। ধলেশ্বরী দ্বিতীয় সেতুতে ওঠার আগে টোল আদায় করা হয়।

এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ায় স্বভাবতই ধারণা ছিল দ্রুতগতির যানই এখানে চলবে। নাহ, এখানে সমানতালে চলছে রিকশা, অটোরিকশা। ধলেশ্বরী দ্বিতীয় সেতুতেই উঠে পড়ল ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা। দেখামাত্রই বাসের চালক হামিদের সহকারী আশিকুজ্জামান চেঁচিয়ে উঠল, ‘এডিই হইছে রাস্তার কুফা। রিকশাগুলান বন্ধ না করলে লাভ হইলো কী।’

এক্সপ্রেসওয়ে ভাঙ্গা অংশ। ছবি: সুহাদা আফরিন
এক্সপ্রেসওয়ে ভাঙ্গা অংশ। ছবি: সুহাদা আফরিন

হাত দিয়ে গাড়ি থামিয়ে সড়ক পার হওয়া এ দেশের মানুষের স্বভাব। সেই ‘ঐতিহ্য’ এই এক্সপ্রেসওয়েতেও প্রয়োগ হচ্ছে। দৌড়ে দৌড়ে সড়ক পার হয় আর লাফিয়ে লাফিয়ে সড়কদ্বীপ!

বাসের মধ্যে একজন পানের পিক ফেললেন। আরেকজন বাস থেকে দেওয়া পলিথিনে বমি করে সেটা বাস থামিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের সড়কদ্বীপের উদ্দেশ্যে ছুড়ে ফেলেন। এ সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ যে শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, প্রতিটি মানুষের, সে অভ্যাস গড়ে ওঠেনি।

এর মধ্যে বাস দুবার থামল। একবার বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের চেকিংয়ের জন্য, আরেকবার যাত্রী নামাতে।

দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে, ছবি তো তুলতেই হয়। মোটরসাইকেল বা ব্যক্তিগত বাহন থামিয়ে অনেকেই ছবি তুলছেন।

সকাল ১০ টা ৫৫ মিনিটে বাস মাওয়া ঘাটে পৌঁছাল। এক্সপ্রেসওয়ের পথটুকু পাড়ি দিতে লাগল ৪০ মিনিট।

এক্সপ্রেসওয়েতে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা। আছে কম গতির যান চলাচলও। ছবি: দীপু মালাকার
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা। আছে কম গতির যান চলাচলও। ছবি: দীপু মালাকার

হামিদ সাহেবের কথাই সঠিক। উনি ৪০ মিনিটেই নিয়ে এসেছেন। অবশ্য ঢাকা–মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মোট পথ ৩৫ কিলোমিটার। তবে কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর থেকে পথ ২৮ কিলোমিটার। গুলল বলছে ৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৯ মিনিট। সেই হিসাবে বাসে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে পাড়ি দিতে সময় লাগছে ৪৯ মিনিট।

লঞ্চে করে শিমুলিয়া ঘাট থেকে কাঁঠালবাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য মধ্যগগনে। এবার ভাঙ্গার বাস ধরার পালা। দুপুর সাড়ে ১২টায় ছাড়ল ভাঙ্গার বাস। সংযোগ সড়ক ও পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক পার হয়ে পাচ্চরে গিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠল বাসটি। সেখানে অবশ্য ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি শেষে পুনরায় বাস ছাড়ে। ঘড়িতে তখন বেলা একটা। এখন থেকে এক্সপ্রেসওয়ে শুরু। ভাঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছাতে বাস তিনবার থামে যাত্রী ওঠানামার জন্য। এর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী বাসের ছাদে উঠে বসে। এক্সপ্রেসওয়ের এই অংশেও দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে চলছে অটোরিকশা।

ভাঙ্গায় এসে বাস থামে দেড়টায়। অর্থাৎ পদ্মা ওপারে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের ২০ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লেগেছে ৩০ মিনিট।

এক্সপ্রেসওয়ের মধ্য দিয়ে সড়ক পার হচ্ছেন পথচারীরা। ছবি: দীপু মালাকার
এক্সপ্রেসওয়ের মধ্য দিয়ে সড়ক পার হচ্ছেন পথচারীরা। ছবি: দীপু মালাকার

বলা হচ্ছে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ৫৫ কিলোমিটার পাড়ি দিতে লাগবে ৪২ মিনিট। এটা অবশ্য পদ্মা সেতু হওয়ার পরের হিসাবে যোগ হবে। আরও বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে মাওয়া যেতে ২৭ মিনিট লাগবে। কিন্তু গতকাল শনিবারের অভিজ্ঞতা বলছে, নদীপথটুকু বাদেই গণপরিবহনে ২৭ মিনিটের অনেক বেশি সময় লেগেছে। অবশ্য ব্যক্তিগত বাহনে চড়ে হয়তো সেটা সম্ভব।

সময় সরকারি হিসাবে মিলুক না মিলুক দক্ষিণবঙ্গবাসী খুশি। ভাঙাচোরা সড়কে ঝাঁকি খাওয়ার দিন শেষ। দৃষ্টিনন্দন সড়ক পেয়েছে তারা। ফরিদপুরবাসী শারমিন আক্তারের বলেন, ‘১০ বছর আগেও ভাবি নাই এমন কিছু হইব। এখন বাসে উঠলেই গেলামগা।’

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সিগঞ্জ ধলেশ্বরী সেতু। ছবি: দীপু মালাকার
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সিগঞ্জ ধলেশ্বরী সেতু। ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নিয়াজ আহমেদের বাড়ি মাদারীপুরে। অন্যান্য জেলার বন্ধুদের এবার নিজ এলাকা দেখাতে আনবেন। নতুন সড়ক পেয়ে বেশ খুশি। তিনি বলেন, ‘এবার অপেক্ষা শুধু পদ্মা সেতুর।’