খেলার মাঠে 'চাঁদার হাট'

মাঠের জায়গায় গড়ে তোলা কাঁচাবাজার। গত শনিবার শ্যামলীতে।  ছবি: প্রথম আলো
মাঠের জায়গায় গড়ে তোলা কাঁচাবাজার। গত শনিবার শ্যামলীতে। ছবি: প্রথম আলো

শ্যামলী রিং রোডে খেলার মাঠের একাংশে বসানো হয়েছে কাঁচাবাজার। বাজারের প্রতিটি দোকান থেকে ভাড়ার নামে আদায় করা হয় বড় অঙ্কের চাঁদা। অভিযোগ আছে, বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম ওরফে রাস্টনের লোকজন।

শ্যামলী ক্লাব মাঠ নামে পরিচিত মাঠটির আয়তন ২ দশমিক ৩২ একর। ডিএনসিসির মালিকানাধীন এই মাঠের প্রায় ২০ কাঠা জায়গা দখল করে বাজারটি গড়ে তোলা হয়েছে। ডিএনসিসি সূত্র জানায়, বাজার বসাতে কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।

শ্যামলী ক্লাব পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও স্থানীয় লোকজন বলেন, ২০০৯ সালের শুরুর দিকে ১৫ থেকে ২০টি দোকান বসিয়ে মাঠের এক পাশে কাঁচাবাজার চালু করেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের নেতা হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান। পরে তিনি ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।ধীরে ধীরে সেখানে দোকানের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৭০টিতে। এসব দোকান থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে আদায় করা হয়। সে হিসাবে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকার বেশি চাঁদা ওঠে।

শ্যামলী ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ মো. ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের অক্টোবরে শুদ্ধি অভিযানে হাবিবুর রহমান মিজান গ্রেপ্তার হন। এরপর তাঁর লোকজনকে বের করে দিয়ে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসান নূর ইসলামের লোকজন।

মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ডিএনসিসির নির্বাচনে ৩২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম। নির্বাচনের আগে তাঁর স্লোগান ছিল ‘আস্থা রাখুন, পাশে থাকুন, কথা দিলাম, বদলে দেব’। নির্বাচিত হয়ে তিনি তাহলে কী বদল করলেন?

>

এক দশকের বেশি সময় ধরে অবৈধভাবে বাজার চলছে
ভাড়ার নামে প্রতি মাসে তোলা হয় অন্তত ১৫ লাখ টাকা

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি বহুবার বাজার থেকে টাকা তোলা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। হাবিবুর রহমান আটক হওয়ার তিন মাস আগে দলীয় লোকজন বাজারটি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। তবে তিনি বলে দিয়েছেন, বাজার থেকে কোনো চাঁদা তোলা যাবে না। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা শতভাগ মিথ্যা ও বানোয়াট।

পারিবারিকভাবে নিজেকে বিত্তশালী দাবি করে সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম বলেন, তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য আওয়ামী লীগবিরোধীরা এমন অভিযোগ করছেন।

৩২ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত এই কাউন্সিলর বলেন, নিয়মের মধ্যে আনতে গেলে সেখানে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব দিতে হয়। তাই শ্যামলী ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বাজার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন।

গত শনিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, রিং রোড হয়ে বাজারের প্রবেশমুখেই শ্যামলী নতুন কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাইনবোর্ড। ভেতরে বড় জায়গাজুড়ে মাছ–মাংস, শাকসবজির দোকান। বাজারের দক্ষিণ পাশে শ্যামলী ইউনিট আওয়ামী লীগ ও শ্যামলী নতুন কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের কার্যালয়। খিলজি রোড হয়ে বাজারে প্রবেশের আরেকটি পথ আছে। প্রবেশমুখে নবনির্বাচিত কাউন্সিলরের বড় ছবি দিয়ে পোস্টার টাঙানো।

কীভাবে দোকান বসিয়েছেন, কাকে ভাড়া দেন—কয়েকজন দোকানির কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা কথা বলতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে বাজার কমিটির সভাপতি ও শ্যামলী ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বলেন, চাঁদাবাজির অভিযোগ মিথ্যা। তাঁরা দোকান থেকে কেবল বিদ্যুৎ ও পানির বিল তুলছেন। এর বাইরে কোনো টাকা তোলেন না।

শ্যামলী ক্লাব কর্তৃপক্ষ বলছে, শ্যামলী ইউনিট আওয়ামী লীগের কার্যালয়টি একসময় ক্লাবের সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের কার্যালয় ছিল। এটি হাবিবুর রহমান দখল করেছিলেন। পরে আর দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

শ্যামলী ক্লাবের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুল কাওনাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারটি বিরাট পয়সার সোর্স। পয়সা ওঠানো বন্ধ হলে এটি সরানো সম্ভব হবে।’ নবনির্বাচিত কাউন্সিলর ও তাঁর অনুসারীরা বাজারটি চালাচ্ছেন দাবি করে তিনি বলেন, স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে এটি সরানো যাচ্ছে না। বিষয়টি তাঁরা সাংসদ সাদেক খানকে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ সাদেক খান প্রথম আলোকে বলেন, শ্যামলী ক্লাব কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে বিষয়টি তাঁকে বলেছে। তিনি বলেন, ‘মাঠ মাঠের জায়গায় থাকুক, বাজার বাজারের জায়গায় চলে যাক, এটাই আমি চাই।’

সাদেক খান বলেন, বাজার ঘিরে চাঁদাবাজির বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে তাঁর ভাষ্য, ‘যেহেতু বাজার আছে, কেউ না কেউ তো চাঁদাবাজি করেই।’

মাঠে বাজার বসানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছি তিন মাসে আগে। এই সময়ে সংস্থার কোনো মাঠে বাজার বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। এর আগে অনুমতি দেওয়া হয়েছে কি না, খোঁজ নিয়ে দেখব। অবৈধ বাজার হলে তা আমরা ভেঙে দেব।’