শজনের গ্রাম খুলনার ঝড়ভাঙ্গা

সারি সারি শজনে গাছ। সম্প্রতি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার ঝড়ভাঙ্গা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
সারি সারি শজনে গাছ। সম্প্রতি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার ঝড়ভাঙ্গা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রাম ঝড়ভাঙ্গা। মেঠো পথ ধরে গ্রামে ঢুকতেই খালের পাড় ধরে চোখে পড়ে সারি সারি শজনেগাছ। ছোট ছোট সাদা ফুল আর কচি কচি শজনে ধরে আছে তাতে।

অনেকের কাছে ওই গ্রাম শজনের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি। চারপাশে চাষের জমির মাঝবরাবর ওই গ্রাম অবস্থিত।

সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গঙ্গারামপুর গ্রাম থেকে ঝড়ভাঙ্গা গ্রামে প্রবেশের পথটি মাটি কেটে পাকা করার প্রক্রিয়া চলছে। ওই পথের এক পাশে খালের মতো হয়ে প্রবাহিত আমতলা নদী। কিছু দূর গিয়েই নদীর একটি শাখা চলে গেছে গ্রামের এক পাশ দিয়ে। ওই শাখার নাম বড় ঝড়ভাঙ্গা খাল। খালের দুই পাশ দিয়ে সারি সারি শজনেগাছ। এখন মৌসুম হওয়ায় শজনেগাছে ফুল ধরে আছে। কিছু কিছু গাছে ফুলের পাশাপাশি বেশ কিছুটা লম্বা শজনে ধরেছে।

মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই দেখা হয় ওই এলাকার অরুণ মণ্ডলের সঙ্গে। এ সময় কথা হলে তিনি বলেন, ওই গ্রামে প্রায় অর্ধশত পরিবারের বসবাস। লোকসংখ্যা সব মিলিয়ে ১৪০, তবে গ্রামটি নতুন নয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই সেখানে মানুষের বসতি।

অরুণ মণ্ডলের শজনেগাছ রয়েছে ২৫টির মতো। গাছগুলোতে হওয়া শজনের বেশির ভাগই তিনি বিক্রি করেন। কিছু রাখেন পরিবারের খাওয়ার জন্য। তিনি বলেন, কেউ না লাগানোর পরও আগে থেকেই ওই গ্রামে অল্প কিছু শজনেগাছ ছিল। ২০১২ সালের দিকে ‘লোকজ’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার পরামর্শে গ্রামের সবাই মিলে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য শজনেগাছ লাগান। এখন পুরো গ্রামে প্রায় ৪০০ ছোট-বড় শজনেগাছ আছে। গ্রামের বসতবাড়ির যেসব খালি জায়গা রয়েছে, সেখানেই গাছ লাগানো হয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর যেতেই দেখা হয় নারায়ণ মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বছর তিনি এক মণের মতো শজনে পেয়েছেন। ওই শজনে বাড়ি থেকেই ব্যাপারীরা নিয়ে যান। শজনে চাষের জন্য তাঁদের কোনো কষ্টই করতে হয় না, একবার গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। তবে নরম জাতের গাছ হওয়ায় পোকার আক্রমণে মরে যাওয়ার হার বেশি। যেহেতু শজনেগাছের ডাল কেটে লাগালেই গাছ হয়, তাই প্রতিবছরই সবাই কিছু কিছু নতুন গাছ লাগান।

বিজয় মণ্ডল নামের গ্রামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ফুল থাকতেই গাছ কিনে নেন ব্যাপারীরা। শজনের যে দাম, তাতে নিজেদের কিনে খাওয়ার সামর্থ্য হয়তো হতো না, কিন্তু গাছ লাগানোর পর শজনের সবজি গ্রামের কমবেশি সবাই খেতে পারছেন।

গ্রামের আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা বলেন, গ্রামে আরও অনেক শজনেগাছ ছিল। কিন্তু গত বছর নভেম্বরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে অনেক গাছ ভেঙে গেছে। এ কারণে এবার তুলনামূলক গাছ কিছুটা কম। তবে এ বছর শজনে পাড়ার পর নতুন করে গাছ লাগানো হবে। শজনে এককালীন ফসল হওয়ায় তা থেকে আহামরি কোনো আয় হয় না, এটা সত্য; তবে কিছু না করেও যে টাকা পাওয়া যায়, সেটাই-বা কম কিসে। তাঁরা জানান, একসময় তাঁদের গ্রামে ব্যাপকভাবে শজনের উৎপাদন হতে দেখে আশপাশের গ্রামের মানুষও শজনেগাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ হন। ফলে ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে এখন ব্যাপকভাবে শজনের উৎপাদন হচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা লোকজের কৃষক নেতৃত্বে থাকা কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের সমন্বয়কারী পলাশ দাশ বলেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে খুলনার উপকূলীয় এলাকার অনেক ফসল এখন আর উৎপাদিত হয় না। তাই কী ধরনের ফসল বা সবজি চাষ করা যেতে পারে, সে ধারণা থেকেই ২০১২ সালের দিকে রোপণ করার জন্য ওই এলাকার কৃষকদের মধ্যে প্রায় ২০০ শজনেগাছের ডাল সরবরাহ করা হয়। ডালগুলো কৃষকেরা খালের চারপাশে রোপণ করেন। পরের বছর থেকেই শজনে পেতে শুরু করেন তাঁরা। তবে গাছ ছোট থাকায় পরিমাণ ছিল কম। তখন শজনের দামও ছিল অল্প। তবে গত কয়েক বছর ধরে শজনের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা প্রতিবছর ডাল কেটে নতুন নতুন জায়গায় গাছ রোপণ করছেন। ওই গ্রামের কৃষকদের দেখে অন্য এলাকার কৃষকেরাও গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।