করোনার নিরাপত্তাসামগ্রী নেই, চিকিৎসকদের উদ্বেগ

মাগুরা জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গতকাল শুক্রবার দুপুরে রোগী দেখছিলেন চিকিৎসক অমর প্রসাদ সাহা। তাঁর টেবিল ঘেঁষে বসা কয়েকজন রোগী। তাদের কারও জ্বর, কারও সর্দিসহ অন্যান্য সমস্যা। এই চিকিৎসকের নিরাপত্তা সরঞ্জাম বলতে মুখে শুধু মাস্ক। তা–ও নিজের টাকায় কেনা। ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসামগ্রী বা পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্টের (পিপিই) অভাবে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ চরমে পৌঁছেছে। 

মাগুরায় সর্দি, কাশি ও জ্বরের চিকিৎসা দেওয়া হলেও বেশির ভাগ জেলায় এ ধরনের রোগীদের হাসপাতালে সেবা দেওয়া হচ্ছে না। তাঁদের হাসপাতালে না এসে ফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হচ্ছে। এ জন্য মাইকিংও করা হচ্ছে ভোলার মনপুরা উপজেলায়। আরও কয়েকটি জেলায় নানাভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রস্তুতির কথা বলা হলেও সারা দেশের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকেরাই নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা জানিয়েছেন। রাজবাড়ী, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ কয়েকটি জেলায় কিছু নিরাপত্তাসামগ্রী পৌঁছালেও এর ব্যবহার শুরু হয়নি। আর কয়েকটি জেলা থেকে জানানো হয়েছে, তাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন বলে জেনেছেন। কুরিয়ারে সরঞ্জাম পাঠানো হলেও এখনো পৌঁছায়নি।

গতকাল শুক্রবার ঢাকার বাইরে দেশের ৫৫টি জেলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারা। কথা বলেছেন ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের সঙ্গেও। বেশির ভাগ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসামগ্রী না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে রোগীদের ভিড়। রোগীদের নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা নার্সকে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডেকে বলেন, জ্বর, সর্দি ও কাশির রোগীদের তিনি দেখবেন না। এ ধরনের রোগী যাবে ১৩০ নম্বর কক্ষে। সেখানে দায়িত্বে থাকা নার্স চিকিৎসাপত্র লেখার কথা শুনে রাগ করে সেই কক্ষ থেকে চলে যান। সেবা পাওয়া নিয়ে এমন অনিশ্চয়তায় হতাশ হয়ে চলে যান কয়েকজন রোগী। তাঁদের একজন শহরের কলেজ রোডের মিনারা বেগম (৩৭)। তিনি দুই দিনের জ্বর নিয়ে হাসপাতালে এসেও চিকিৎসা না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বললেন, করোনাভাইরাসের কারণে জ্বরের রোগী দেখছেন না চিকিৎসকেরা। আরেক রোগী জেলার কৃষ্ণকাঠি এলাকার সুখী আক্তার (২২) প্রচণ্ড জ্বরে দাঁড়াতেই পারছিলেন না। তিনি বলেন, ডাক্তার ভয়ে দেখতেই আসেননি আর সর্দি–কাশি কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। 

জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জুবায়ের ওয়াশিদ বলেন, মাস্ক, গাউনসহ নিরাপত্তা সরঞ্জাম এখনো সরবরাহ করা হয়নি। তিনি নিজে কিছু সরঞ্জাম কিনে অন্যান্য রোগী দেখছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে সর্দি, কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের সরাসরি দেখার মতো পরিস্থিতি নেই বলে মনে করেন তিনি। এ জন্য তাদের বিশেষ কক্ষে পাঠানো হচ্ছে। সেখান থেকে চিকিৎসাপত্র নিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হচ্ছে। বেশি সমস্যা হলে হটলাইনে যোগাযোগ করতে হবে। 

ভোলার ৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ভোলা সদর হাসপাতালে পিপিই নেই চিকিৎকদের কাছে। ভোলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক তৈয়বুর রহমান বলেন, তিনি নিজে সর্দিতে ভুগছেন। এখানে আবার তাঁকেই সর্দি–কাশি রোগীর চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসার জন্য তাঁর নিজের নিরাপত্তাসামগ্রী খুবই জরুরি। তাই তাঁরা সর্দি, কাশি, জ্বর ও গলাব্যথার রোগীদের হাসপাতালে আসতে নিরুৎসাহিত করছেন।

জেলার মনপুরা উপজেলায় সর্দি–কাশির রোগীদের সরাসরি হাসপাতালে না আসার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। এ ধরনের রোগীদের ফোনে পরামর্শ নিতে বলা হচ্ছে বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান।

নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসকেরা দূর থেকে কথা বলে রোগীদের পরামর্শ দিচ্ছেন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নাঈমা নুসরাত বলেন, আতঙ্কে তাঁরা সর্দি, জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের ভর্তি বন্ধ রেখেছেন। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকায় চিকিৎসা দিচ্ছেন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। 

নরসিংদী সদর হাসপাতালে গতকাল দুপুরের দিকে একজন নারী আসেন সর্দি-কাশির সমস্যা নিয়ে। তাঁকে হাসপাতালের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা একটি নোটিশ দেখিয়ে বলা হয়, এরপর থেকে হাসপাতালে না এসে ফোন করবেন। এরপর তাঁকে ‘কোয়ারেন্টিনে’ থাকতে বলা হয়। নরসিংদীর সিভিল সার্জন মো. ইব্রাহীম জানান, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা সর্দি, কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের আপাতত নিজ নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাদের সবাইকে জরুরি ফোন নম্বরগুলো দিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরবর্তী সময়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য। 

মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢোকার মুখে স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীদের বলছেন, ‘জ্বর, সর্দি-কাশি থাকলে বাসায় চলে যান। নাপা, প্যারাসিটামল খান। ফোন করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।’ 

হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাকর্মীরা সামাজিকভাবেও চাপের মুখে পড়ছেন বলেও কেউ অভিযোগ করেছেন। দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে একজন জ্যেষ্ঠ নার্স জানালেন, তিনি শহরের বালুবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। গত বৃহস্পতিবার বাড়িওয়ালা তাঁকে ডেকে কিছুদিন অন্যত্র থাকার কথা জানিয়েছেন। বাড়িওয়ালার আশঙ্কা, তিনি ওই বাড়ির সবার জন্যই করোনাভাইরাসের জীবাণুর বাহক হতে পারেন।

এই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সোহেল পারভেজ বলেন, চিকিৎসক–নার্সদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসামগ্রীর চাহিদা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। হয়তো দু–এক দিনের মধ্যে পাওয়া যাবে। 

নিরাপত্তাসামগ্রীর সংকট রয়েছে গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) সঞ্জীব কুমার ধর বলেন, ‘সকালে (গতকাল) কোটালীপাড়া থেকে একজন রোগী আসেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁর কাছে গিয়ে দেখতে পারিনি। কারণ, জরুরি বিভাগে এখন পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তাসামগ্রী দেওয়া হয়নি।’ 

প্রস্তুত নয় আইসোলেশন ইউনিট

নওগাঁ আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে শহরের পুরোনো হাসপাতাল এলাকার একটি ভবনে করোনা–আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য আইসোলেশন ইউনিট খোলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে কোনো চিকিৎসককে পাওয়া গেল না। সেখানে থাকা দুজন নার্স জানালেন, তাঁদের বিশেষায়িত গাউন, মাস্ক, জুতা ও চশমা দেওয়া হয়নি। এক নার্স বলেন, ‘করোনাভাইরাস আক্রান্ত কোনো রোগী আসলে আমরাই আগে পালাব। কারণ, আমাদের নিজেদেরই কোনো নিরাপত্তা নেই।’