খুলনায় করোনার প্রভাব: মানুষের উপস্থিতি ও যানবাহন কম

খুলনা রেলস্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা খুলনা-রাজশাহী সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আল মামুন। খুলনায় সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি।

আল মামুন বলেন, কয়েক দিন ধরে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা যশোরে রয়েছেন। কখন যে সারা দেশ লকডাউন হয়ে যায়, এই ভয়ে তাঁদের সেখান থেকে নিয়ে আসতে যাচ্ছেন।

নগরের বাস্তুহারা এলাকায় রংমিস্ত্রির কাজ করেন মো. ডালিম। স্বল্প আয়ের মানুষটি করোনাভাইরাসের প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি বাজারসদাই করে রেখেছেন। 

ডালিম বলেন, কখন কী হয়, বলা মুশকিল। ধীরে ধীরে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় ২ বস্তা চাল, ২৫ কেজি পেঁয়াজ, ১৫ লিটার তেলসহ প্রায় তিন গুণ বেশি বাজার করে ঘরে রেখেছেন।

শুধু আল মামুন বা ডালিম নয়, এমন পরিস্থিতি এখন খুলনার প্রত্যেক মানুষের মধ্যে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। আর বের হলেও অধিকাংশই মাস্ক ব্যবহার করছে। গতকাল বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের উপস্থিতি তুলনামূলক অনেক কম। সড়কে যানবাহনও কম দেখা গেছে। জুমার নামাজেও মসজিদগুলোতে মুসল্লি ছিলেন কম। যাঁরা নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই মাস্ক পরে ছিলেন। তবে সব মসজিদেই করোনা থেকে মুক্তির জন্য বিশেষ দোয়া হয়েছে। 

করোনা–আতঙ্কের মধ্যে অনেকেই তাঁর পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। গ্রামে মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় সেটাকেই নিরাপদ মনে করছেন তাঁরা।

গতকাল শুক্রবার দুপুরের দিকে সোনাডাঙ্গা আন্তজেলা বাস টার্মিনালে পিরোজপুরে গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের পাঠাতে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন সিরাজুল ইসলাম। সঙ্গে ছোট দুই মেয়েসহ এক নারী। সিরাজুল বলেন, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। দিন শেষে বাড়ি ফিরে বাচ্চারা কাছে এলে আতঙ্কে থাকতে হয়। তাই চিন্তামুক্ত থাকতে এবং পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার জন্য গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে থাকা খুলনা-কুষ্টিয়া বাস কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা লুৎফর রহমান বলেন, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ বের হচ্ছে না। করোনা–আতঙ্কেই যাত্রী অনেক কমে গেছে। ১০ মিনিট পরপর বাস ছাড়ার কথা থাকলেও অনেক সময় যাত্রী কম থাকায় ৩০ মিনিট পর বাস ছাড়তে হয়েছে। যাঁরা যাচ্ছেন তাঁদের অধিকাংশই গ্রামের বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।

খুলনা-মোংলা রুটের সোনাডাঙ্গা কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা সৈয়দ আনোয়ার বলেন, এমন পরিস্থিতি আগে কখনো সৃষ্টি হয়নি। ১০ থেকে ১৫ জন যাত্রী নিয়ে বাস ছাড়তে হচ্ছে।

বিকেল চারটার দিকে খুলনা রেলস্টেশন থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায় সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস। প্রায় ২০ মিনিট স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, যাত্রীর উপস্থিতি তুলনামূলক অনেক কম। বেশির ভাগই নারী ও শিক্ষার্থী। খুলনার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফিরছেন তাঁরা।

ওই স্টেশনের টিকিট বুকিং সহকারী কামরুল ইসলাম বলেন, ট্রেনে সার্বিক যাত্রীর সংখ্যা, বিশেষ করে ঢাকাগামী যাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মুদিদোকানগুলোতে স্বাভাবিকভাবে কেনাকাটার পরিমাণ বেশি থাকলেও গতকাল মানুষের কেনাকাটার পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খেতে দেখা গেছে দোকানিদের। ক্রেতারা অস্বাভাবিক পরিমাণ পণ্য কিনছেন বলে দাবি করেন তাঁরা।

নগরের নিরালা এলাকায় থাকা নয়ন স্টোরের মালিক নাসির উদ্দিন মোল্লা বলেন, মানুষ রোজার সময় যেমন জিনিসপত্র কেনেন, কয়েক দিন ধরে তেমন পরিমাণ কেনাকাটা করছেন। যাঁর এক বস্তা চাল প্রয়োজন, তিনি ১০ বস্তা পর্যন্ত চাল কিনছেন। এ ছাড়া অন্যান্য সামগ্রী তো রয়েছেই। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ক্রেতাদের সঙ্গে অহরহ বাগ্‌বিতণ্ডার ঘটনা ঘটছে।

অন্যদিকে করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে বৃহস্পতিবার থেকে নগরের মধ্যে থাকা সাতটি পার্ক বন্ধ ঘোষণা করেছে সিটি করপোরেশন।

বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন স্বাক্ষরিত জনসমাগম না করতে এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপনে জেলায় সব প্রকার সভা, সেমিনার, মিটিং, সামাজিক অনুষ্ঠান, গণজমায়েত ও ধর্মীয় গণজমায়েত না করার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পযন্ত ওই নির্দেশনা কার্যকর থাকবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। 

হোম কোয়ারেন্টিন

করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে গতকাল পর্যন্ত ১৯২ জন বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে শুধু গতকালই রাখা হয়েছে ১৩২ জনকে। নতুন করে যাদের কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে দাকোপ উপজেলায় ১১ জন, বটিয়াঘাটায় ৪ জন, রূপসায় ২৮ জন, তেরখাদায় ২ জন, দিঘলিয়ায় ১ জন, ফুলতলায় ৮ জন, পাইকগাছায় ২৯ জন, কয়রায় ১২ জন ও খুলনা নগরের মধ্যে ৩৭ জন রয়েছে।